“কবির কাজ স্বপ্ন দেখানো, আমি এই জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছি।” — আল মাহমুদ
[আল মাহমুদ (জন্ম, ১১জুলাই, ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ) আমার প্রিয় কবি, আমাদের ভাষার অন্যতম প্রধান কবি। তিনি একধারে একজন কবি, ঔপন্যাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ ছোটগল্পকার। তিরিশ এর কবিদের হাতে বাংলা কবিতায় যে কথিত আধুনিকতার ঊন্মেষ, তার সফলতারপতাকা আল মাহমুদ পঞ্চাশের দশক থেকে এখনো পর্যন্তগর্ব ও কৃতিত্বের সঙ্গে বহন ক’রে চলছেন।
রবীন্দ্র-বিরোধী তিরিশের কবিরা বাংলা কবিতার মাস্তুল পশ্চিমের দিকে ঘুরিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন, আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতাকে বাংলার ঐতিহ্যে প্রোথিত করেছেন মৌলিক কাব্যভাষার সহযোগে— তাঁর সহযাত্রী শামসুর রাহমান, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের তুলনায় এইখানে তিনি ব্যতিক্রমী ও প্রাগ্রসর।
আল মাহমুদ মাটিঘেঁষা অনুভূতিতে নিজের অভিজ্ঞতাজাত গ্রামীণ শব্দপুঞ্জ, উপমা-উৎপ্রেক্ষা এবং চিত্রকল্প সংশ্লেষ করে আধুনিক বাংলা কবিতার নতুন দিগন্তরেখা টেনেছেন। একই সঙ্গে তিনি কথাসাহিত্যে তাঁর মৌলিক শৈলীর স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ অভ্যূদয়ের পর তিনি দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে সরকার বিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।নব্বই দশক থেকে ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে ইসলামের অনুবর্তী হয়ে তিনি দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীমহলের তীব্র সমালোচনা সহ্য করছেন।
“আমার ঘরের পাশে ফেটেছে কি কার্পাশের ফল?
গলায় গৃঞ্জার মালা পরো বালা, প্রাণের শবরী,
কোথায় রেখেছো বলো মহুয়ার মাটির বোতল
নিয়ে এসো চন্দ্রালোকে তৃপ্ত হয়ে আচমন করি।
ব্যাধের আদিম সাজে কে বলে যে তোমাকে চিনবো না
নিষাদ কি কোনদিন পক্ষিণীর গোত্র ভুল করে?”
এমন শব্দ জাদুময়তার ভেতর দিয়ে আল মাহমুদ তাঁর পাঠকদেরকে চমকিত করে যাচ্ছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে।‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিনী’র ‘সোনালী কাবিন’ আল মাহমুদকে এনে দিয়েছে তুমুল কবিখ্যাতি। আল মাহমুদের কবিতা ভিন্ন বাঁক নেয় মূলত ‘মায়াবি পর্দা দুলে ওঠো’-র ভেতর দিয়ে। আল মাহমুদের আদর্শগত চেতনারও পরিবর্তন হয় এসময়। ‘মায়াবি পর্দা দুলে ওঠো’ ও ‘আমি, দূরগামী’তে তিনি মোহামেডানিজম বা ইসলামের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত হয়ে পড়েন। সেই চেতনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই কাব্যে। পরবর্তীতে ‘প্রহরান্তের পাশ ফেরা’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ প্রভৃতি কাব্যেও তিনি এই চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটান।
এই সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছে ২০১১ সালে কবির জন্মদিনে, তাঁর বাসায়। প্রচুর মানুষের আনাগোনার মধ্যে, কয়েকদফায়। কবির ভক্তশুভার্থীরা সেদিন ফুলে ফুলে ভরে দিয়েছিলো মগবাজারে কবির ছোট্ট বসার ঘর।
ট্রান্সক্রিপ্ট করতে অনেক সময় লেগে গেলো, কবি হিজল জোবায়েরকে ধন্যবাদ ক্রমাগত তাগাদা দিয়ে হেলায় ফেলে রাখা ইন্টারভিউটি শেষ করায় অবদান রাখার জন্য। কবি আবিদ আজমকে ধন্যবাদ প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যেও আগ্রহ ভরে আমার সাথে বারবার কবির কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছেন বলে। ছেড়া ছেড়া আলাপগুলি জড়ো করা হলো নকটার্নের পাঠকদের জন্য।
——শিমুল সালাহ্উদ্দিন ]
আল মাহমুদ- এর সাক্ষাৎকার
শিমুল সালাহ্উদ্দিন: মাহমুদ ভাই, কেমন আছেন?
আল মাহমুদ: ভালো। খুব ভালো আছি। কবিতার মানুষরা এলে (সামনে উপবিষ্ট আসাদ চৌধুরীসহ কবিদের দেখিয়ে) আমার সবসময় ভালো লাগে।
প্রচুর মানুষ আপনাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছে। এই ব্যাপারটা কেমন লাগে!
খুব আনন্দ পাচ্ছি। দেখো কত ফুল। কত শুভেচ্ছা। এগুলোই বলে দিচ্ছে খুব একটা মন্দ লিখিনি এত বছর ধরে। বাংলা কাব্যে আমার একটা উঁচু অবস্থান তৈরি হয়েছে।
অবস্থান তৈরি হবার বিষয়টা আপনাকে আনন্দ দেয় তাহলে!
অবশ্যই। অবশ্যই আনন্দ দেয়। দেখো কবিকে যত অবহেলা সহ্য করতে হয়, সেরকম আর কাউকে করতে হয় না। প্রাপ্তির বেলায়ও কবির তুল্য তাই কারো থাকা উচিত নয়। এটা বলতে পারি, এ জীবনে কম পাইনি আমি।
আপনি তৃপ্ত আপনার জীবন নিয়ে?
তা বলতে পারো। তবে আমি কবিতা নিয়ে তৃপ্ত নই।
কবিতা নিয়ে তৃপ্ত নন কেনো?
অনেক কবিতা লিখেছি সত্যি, কিন্তু যে কবিতাটি লিখতে চাই সেটি যেনো লেখা হয়নি। হলে এখনো লিখতে চাইবো কেনো?
হা হা হা। এই অতৃপ্তির নামই কী তাড়না মাহমুদ ভাই?
অতৃপ্তি না থাকলে কবির কলম লিখবে না আর। তাই লেখক, শিল্পীর জন্য অতৃপ্তি প্রয়োজন।
আপনার জন্ম তো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, ঢাকা প্রথম এলেন কবে!
আমি ঢাকায় আসি১৯৫৪ সালে, প্রথম।শীতকাল তখন। ট্রেনে এসেছিলাম। কমলাপুর রেলস্টেশনে।
মানে ভাষা আন্দোলনের পরপরই?
পরপরই। ভাষা আন্দোলনের কথা ঢাকায় আসার আগেই শুনেছিলাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও ভাষা কমিটি হয়েছিল। সেখানে আমার কবিতা ছিল। সেই কবিতার লেখককে পাকিস্তান পুলিশ খুঁজছিল বলেই পালিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম।
বাবা! এত্ত সাহস! তখনি! কোন ক্লাসে তখন আপনি?
ক্লাস টেন।
কবিতা লেখা তো অপরাধ না! আপনি পালালেন কেন?
পাকিস্তান সরকার মামলা করছিল। থানায় ধরে নিয়ে যেত আগে, তারপর মামলা। গ্রেফতার থেকে রক্ষা পেতেই পালিয়ে ঢাকায় এসেছিলাম।
ঢাকায় কই এলেন? পরিচয় ছিলো কারো সাথে?
এত ভালো করে মনে নেই। দাদাভাই এর সাথে (রোকনুজ্জামান খান দাদুভাই) পরিচিত একজনের মাধ্যমে তার কাছে এসে উঠেছিলাম।
(আলাপের এই পর্যায়ে কবি বিরতি নিতে চান। প্রক্ষালন কক্ষ যাবেন, সিগারেট খাবেন বলে, আমরা অপেক্ষা করি। এরপর যখন আবার আলাপ শুরু হয়, তখন সূর্য তীব্র মধ্যগগণে, আমরা তাঁর শোবার ঘরের বারান্দায়)
মাহমুদ ভাই, আপনার রাজনীতি ও ধর্মচিন্তা নিয়ে প্রশ্ন করতে চাই। অসুবিধা নাই তো!
অসুবিধা কিসের! দেখো, এখন আর কাউকে ভয় পাই না। বলো, তোমার কি প্রশ্ন।
না, আপনার রাজনীতি তো আপনার কবিতা মোতাবেক সুষম ফসল বন্টনের রাজনীতি। মানে সাম্যবাদ। অথচ লোক এখন আপনাকে একটি ধর্মভিত্তিক দলের ছায়াতলে দেখতে পায়! এটাকে কিভাবে দেখেন!
তুমি ভাল কবিতা লেখো, তখন শুনলাম। এখন বলো, তুমি সকাল বেলা কিভাবে নাস্তা করো, তা কি বিকেলবেলা লেখা তোমার কবিতায় প্রভাব রাখে! ধর্ম, বিশ্বাস মানুষের ব্যক্তিগত আচরণ। সামাজিক প্রভাব থাকলেও। আমি কি বিশ্বাস করবো, কাকে পছন্দ করবো এটা তো আমার সিদ্ধান্ত। অন্য কেউ কেনো আমার সিদ্ধান্ত কি হবে তা ঠিক করে দিতে চাইবে! বলো, সেটা কি অন্যায় নয়?
সৈয়দ হাসান ইমাম বলেছেন, আপনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, কিন্তু আপনার এখনকার যা ভূমিকা সেজন্য উনি কোন অনুষ্ঠানে আপনার সাথে ডাকলে যাবেন না!
এটা তার ব্যাপার। আমি কিন্তু যাবো। মানুষ বেঁচে থাকলে বদলাবে। তাই বলে সে জীবনে যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে তা তো বদলাবে না। বলো, বদলাবে?
না মাহমুদ ভাই, বদলাবে না। কিন্তু সরাসরি জামায়াতে ইসলামী, বা শিবিরকে আপনি সমর্থন করছেন, তাদের প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন, একজন প্রগতির পক্ষের মানুষ হিসেবে আপনার অনেক ভক্তও তো এটা মেনে নিতে পারে না!
তাহলে সে ভক্তিতে ভেজাল আছে। আর, ভক্তের কি এটা মানার দরকার আছে! যে আমার কবিতা ভালোবাসে সে তো আমার কবিতার ভক্ত। আমার না। আমি ব্যক্তিমানুষ, আমার আচরণ, সামাজিক অবস্থান, সমর্থন এসব মানুষ হিসেবে আমার বিবেচনার ফল, সিদ্ধান্তের ফল। তাকে বিচার করার অধিকার অন্য কাউকে দেয়া হয় নাই। আমি চাই না কেউ আমার কবিতা পছন্দ করেন বলে আমার মতাদর্শ পছন্দ করবেন। তুমি যাদের কথা বললে, তারা আমাকে ভালোবাসে। তারা আমার যত্ন নেয়। আমি কারো ভালোবাসাই ফিরিয়ে দিতে পছন্দ করি না। আমাকে তারা নিজের মানুষ মনে করে।
(হাতের সিগারেটের দিকে ইঙ্গিত করে) আপনি কি শিবির কিংবা জামাতের মিটিং এ গিয়েও ধূমপান করেন?
হ্যাঁ, করি। এটা তো আমি সব জায়গায় করি।
উনাদের অনেক কষ্ট করে আপনাকে সহ্য করতে হয় (হাসিসমেত)!
না। ওরা জানে এখন। দেখো কত ফুল নিয়ে বাসায় এসেছে। অনেকে মিষ্টি এনেছে।
মাহমুদ ভাই, ১৯৫৪ তে ঢাকায় এলেন। পাকিস্তান আমল। আপনি টেন পাশ। চাকরি পেলেন?
ঢাকার আসার পর আমার কিছু কবিতা প্রকাশিত হল। ঢাকার পত্রিকায়। কলকাতার পত্রিকায়। ভাবলাম, পেশা হিসেবে লেখালেখিই করবো। (রোকনুজ্জামান খান) দাদাভাইয়ের শুপারিশে দৈনিক মিল্লাত এ প্রথম আমার চাকরি হয়। পরে সাপ্তাহিক কাফেলায় কাজ করলাম। তারপর একাত্তর পর্যন্ত ইত্তেফাকে।
বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধে, স্বাধীকার আন্দোলনে ইত্তেফাক বিশাল ভূমিকা পালন করেছে। আপনি তখন কর্মরত ইত্তেফাকে। তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিঞাও আছেন। যুগান্তকারী সব সংবাদ, হেডলাইন দিয়ে ইত্তেফাক ইতিহাস তৈরি করেছে।
অসাধারন ছিলো সেই দিনগুলো। আমার সাংবাদিকতা জীবনের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধে ইত্তেফাকের মধ্যে দিয়ে আমরা অনেকে যুদ্ধটা করেছি। এবং সেই যুদ্ধে আমাদের জয় হয়েছে। ভাবতে ভালো লাগে, আমি সেই ইতিহাসের একজন প্রত্যক্ষদর্শী।
মুক্তিযুদ্ধের পর, মানে ৭২ এ আপনি ‘দৈনিক গণকন্ঠ’র দায়িত্ব নিলেন!
মুক্তিযুদ্ধের পরপরই বাংলাদেশের তখনকার অস্থির রাজনীতি, দুর্ভিক্ষ, সর্বহারা আন্দোলন, রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার এসব নিয়ে গণকণ্ঠ দারুণ নির্ভিক কাজ করেছে। তোমরা এখন এমন সাংবাদিকতা ভাবতেও পারো না। সেই পরিস্থিতিতে, ‘গণকন্ঠ’-র ভয়ডর ছাড়া সাংবাদিকতা দেশের মানুষের সমর্থন পেলেও শাষক গোষ্ঠির কোপানলে পড়ে।
এর সম্পাদক হিসেবেই তো জেলে গেলেন ১৯৭৩ এ?
হ্যাঁ। মুজিব সরকারের আমলারা কোনভাবে টের পায় সব নাকি আমার পরিকল্পনায় হয়। আমার ভাষায় হেডলাইন হয়। কারাগারে রক্ষি বাহিনী আমাকে জেরা করেছে অশ্লীল ভাষায়। মারধর করেছে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুই তো আপনাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে এনে শিল্পকলায় চাকরি দিলেন!
সেটা তো করুণা করে না। আমি কারো করুণ নেই নাই। আমার কবিখ্যাতির জন্য উনি এটা করতে একভাবে বাধ্য হয়েছিলেন। অনেকে আওয়াজ তুলেছে আমার মুক্তির জন্য। আর শেখ মুজিব আমার কবিতা পছন্দও করতেন।
শিল্পকলায় আপনাকে কী চাকরি দিলেন বঙ্গবন্ধু?
আমি প্রকাশনা বিভাগের সহপরিচালক হিসেব জয়েন করেছিলাম। ৯৪ সালে অবসরে এসেছি। (আদতে ৯৩ সালে পরিচালকরূপে অবসরে নিয়েছেন।)
রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের কারণে, গণকণ্ঠের সম্পাদক হিসেবে কারাবাসের কারণেই কি আপনি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির প্রতি আপনার সমর্থন উঠিয়ে নিলেন? মার্কসবাদী ছিলেন, ইসলামী হয়ে গেলেন?
না। মানুষের জীবনে দর্শনের পরিবর্তন হতে পারে। আমি একটি গরিব মুসলমান ঘরে অনেক ভাইবোনের মধ্যে বড় হয়েছি। অল্প খাবার কাড়াকাড়ি করে খেয়ে আমরা সবাই বড় হয়েছি। আমাদের জীবনবোধ সমাজের অন্য সবার মতোন নয়। আমার জীবন বোধ আমার মতোন। আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। কিন্তু আমি ব্যক্তিজীবনে ধর্মপালনের পক্ষপাতি।
আপনি তো মায়ের দিকে থেকে প্রচণ্ড ইসলামপন্থী পরিবারের ছেলে। আপনার নানা মোল্লা ছিলেন শুনেছি।
ঠিকই শুনেছো। তবে শুধু মার দিক থেকে না, বাবার দিক থেকেও প্র্যাকটিসিং ইসলাম পরিবারে আমার বেড়ে ওঠা।
যেভাবে বেড়ে উঠছিলেন… বিশদ বর্ণনা।
হ্যাঁ। আমার নানাবাড়ি মোল্লাবাড়ি নামেই পরিচিত ছিলো। মৌড়াইল গ্রামের নাম। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানেই আমার জন্ম। আর আমাদের পূর্বপুরুষেরা, ধরো, ১৫০০ সালের দিকে ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে কাইতলায় এসেছিল। এমন ইতিহাস পাওয়া যায়। দুই দিক থেকেই আমি ধর্মের ব্যাপারটা পেয়েছি।
আপনার কবিতায়ও প্রচুর ইসলামী অনুষঙ্গ এসেছে। ইসলামী মিথ আপনি ব্যবহারও করেছেন প্রচুর?
হ্যাঁ, সেটা সচেতনভাবেই করেছি।
আচ্ছা। মাহমুদ ভাই, এখন আপনার শারীরিক যে অবস্থা, তাতে নামাজ রোজা করতে পারেন সব!
চেষ্টা করি। সব হয়ে ওঠে না।
এই যে ঊন-আশিতে পা দিলেন, কেমন কাটলো দিনগুলো?
সুখে দুখে মিলিয়ে দিনগুলো কেটে গেছে, বয়স আমার তো ঊন-আশি বছর, নট এ ম্যাটার অব জোক!
ইয়া!
হ্যাঁ, তো, পাড়ি তো দিয়ে এসেছি কত সাগর নদী। আমার কাজ ছিলো যেটা, স্বপ্ন দেখাবার কাজ ছিলো, কবির কাজ তাই। এটা আমি দেখিয়েছি এই জাতিকে।
সাগর নদী পাড়ি দিয়ে এলেন, কী ছিলো সাগরে, নদীতে মাহমুদ ভাই?
অনুরাগ, বিলাপ এগুলো আমি পেছনে ফেলে এ পর্যন্ত এসেছি। স্বভাবতই আমি চাইবো এখন চাইবো, শান্তিতে যেনো আমার প্রস্থান হয়। আমার জীবনের সমাপ্তি ঘটুক।
এসময়ের তরুণ কবিদের কি বলবেন?
কবিদের শুধু আমি একটা কথাই বলবো, তা হলো যে, লিখতে হবে, পড়তে হবে হ্যাঁ, বিশ্বসাহিত্যের একটা তরঙ্গ আছে, আন্তর্জাতিক সাহিত্যের, কে কোথায় কি লিখছে, কিভাবে লিখছে, কেনো লিখছে, এটা জানতে হবে। আমাদের কালে আমরা যথেষ্ট খোঁজখবর করেছি। নিজেরা যাই লিখি, আমরা কিন্তু পড়েছি। আমাদের কেউ মূর্খ বলতে পারবে না। আমাদের সময়ে আমরা জানতাম পৃথিবীতে কে কোথায় কিভাবে কি লিখছে!
আপনার ছোটগল্প ‘জলবেশ্যা’ নিয়ে সিনেমা হচ্ছে কোলকাতায় শুনলাম। আপনি জানেন কিছু!
একজন আমাকে ফোন করে অনুমতি চেয়েছিল। আমি হ্যাঁ বলে দিয়েছি। কেউ করতে চাইলে না করবো কেনো?
এটা তো পানকৌড়ির রক্তর ই গল্প। ছোটগল্পের দুই খণ্ড বেরিয়ে গেছে আপনার। আপনার ছোটগল্প আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আমাদের ছোটগল্পে।
তুমি এতো যত্ন নিয়ে পড়েছো জেনে ভাল লাগলো। আমি যে কাজ গল্পে করেছি সেটা আমার ধারণা বাংলা সাহিত্যের ছোটগল্পে স্টোরি রাইটার হিসেবে আমার অবদান আছে। বড় অবদান। আমি অনেক পরিশ্রম করেছি। আমি লিখেছি।
আপনি গল্পে এমনকী কবিতায়ও, কম ব্যবহৃত শব্দ ক্যারিশম্যাটিকভাবে ব্যবহার করেন। আপনার শব্দব্যবহার আলাদাভাবে চোখে পড়ে—
আমি এটা ধরতে পেরেছিলাম যে, বাংলা ভাষায় অনেক শব্দ আছে যেটা সাধারণভাবে আমরা ব্যবহার করি না। আমি সে শব্দগুলোর যুৎসই প্রয়োগ নিয়ে অনেক ভেবেছি। তার প্রভাব আমার কবিতায়, গদ্যেও পড়েছে।
একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই, সৈয়দ হাসান ইমামের কাছে শুনেছি আপনি মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু আপনি কী অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন?
যদি শুধু গোলাবারুদের কথা বলো তবে আমি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করিনি। আমি আমার মতো যুদ্ধটা করেছি। আমি মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র ছাড়াও এই দেশের স্বাধীনতার জন্য অনেক লেখক কবি সাহিত্যিক শিল্পী যুদ্ধ করেছেন।
আমাদের হক ভাই যেমন মুক্তিযুদ্ধ করেন নাই কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি নিয়ে, বঙ্গবন্ধু নিয়ে প্রচুর কবিতা, কাব্যনাট্য লিখেছেন। আপনি তেমন লেখেন নাই! কেনো?
মুক্তিযুদ্ধের ভেতর ও বাহির দুইটাই আমার দেখা। মুক্তিযুদ্ধের উদ্দীপনা থেকে লেখা কবিতাও আমার আছে। কবিতার চেয়ে বেশি গদ্য লিখেছি, উপন্যাস লিখেছি। যুদ্ধ তো নিষ্ঠুর ব্যাপার। এটা নিয়েই পড়ে থাকতে চাই নাই আমি। এটাকে ব্যবহার করতেও চাই নাই অনেকের মতো। তুমি তো নাম বললা।
মুক্তিযুদ্ধে তো আপনার পরিবারের অনেক ক্ষয়ক্ষতি—
হ্যাঁ হয়েছে। অপরিসীম ক্ষতি হয়েছে। যে মামুদের বাড়িতে আমি খেয়েপরে মানুষ হয়েছি সেই বাড়ি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অনেক স্বজন মারা গেছে আমার।
এটা শোনা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি সীমান্তের ওপাড়ে ভগ্নীপতির আশ্রয়ে আরামেই কাটিয়েছেন!
কেউ যদি নিন্দা করতে চায়, তাহলে অনেক ভাবেই পারে। হু! আমি স্বাধীনতার জন্য অনেক কাজ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় কোলকাতায় আমাদের এখান থেকে যাওয়া বাঙালি লেখক কবিদের একটা অংশ কত কাপুরুষের মতো কাজ করেছে সেটা তো আমি জানি। এখন এসব মনে হলে মন খারাপ হয়ে যায় আমার। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধী অনেক লেখকই এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দাবিদার। আমি এসব থেকে দূরে থাকতে চেয়েছি, আমি বাজার মাৎ করার লোক নই।
কিন্তু আপনি তো রাজনীতি করেন! জামায়াতে ইসলামী বা শিবিরের সাথে আপনার সংশ্লিষ্টতা তো আছে!
শিমুল মনে রাখতে হবে সবার, আমি কবি, রাজনীতিক না। আমি আগে থেকেই জানতাম একদিন নকল মুক্তিযোদ্ধাদের দাপটে এদেশে টেকা যাবে না। ১৯৭৫ সালটাই ছিলো নকল মুক্তিযোদ্ধাদের উত্থানের বছর। উঠে আসার বছর। এখন সরকারের পক্ষাবলম্বন করা অনেক কবিই তো আমি জানি ৭৫ এর আগে বাংলাদেশে ফেরে নাই।
আচ্ছা।
এসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না।
ঠিক আছে মাহমুদ ভাই, আমরা কবিতার দিকে ফিরি। ঢাকায় আসার আগেই তো আপনার কবিতা ছাপা হয়েছিল ঢাকার পত্রিকায়!
হ্যাঁ। তা হয়েছিল। কবিতা প্রকাশিত হয়েছিলো কোলকাতার কয়টা পত্রিকায়। চতুষ্কোন, চতুরঙ্গ, ময়ূখ আর কৃত্তিবাসেও।
এগুলোতে লিখেই তো আপনি পরিচিতি পান!
তা বলতে পারো।
আপনাকে তো বুদ্ধদেব বসু কবিতা পত্রিকা থেকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন!
চিঠি না পোস্টকার্ড। শাদা ছাইরঙের একটা পোস্টকার্ড।
কী লেখা ছিলো সেটাতে?
তিনটা কবিতা পাঠিয়েছিলাম কবিতা পত্রিকার জন্য। ওটাতে লেখা ছিলো ‘প্রীতিভাজনেষু, তোমার একটি বা দুটি কবিতা ছাপা যাবে বলে মনে হচ্ছে”।
শুধু এই একলাইনই?
প্রথম ঐ একলাইনই। এটা আমার জীবনের একটা বিশাল ঘটনা। আমি বুদ্ধদেব বসুকে খুব শ্রদ্ধা করি। তার কবিতাকেও।
আল তিরিশের অন্য কবিদের?
তিরিশের কবিদের যৌবন আমরা দেখেছি দীর্ঘ সময় ধরে। তাদের কবিতায় মৌলিকত্ব কম মন হয় আমার। প্রচুর ইয়োরোপীয় প্রভাব। আমি তো পড়েছি, বিভিন্ন ভাষার কবিতা।তিরিশের কবিরা চৌর্য্যবৃত্তিনির্ভর সাহিত্যচর্চা করেছেন, তারা আসলে বাঙালি কবি না, ইয়োরোপের সে সময়ের কবিতা পড়লেই তাদের সাথে এখানকার কবিদের সম্পর্ক পাওয়া যায়। ব্যতিক্রমও আছে। চল্লিশে আবার ভিন্ন চেহারা।
তাদের মধ্যে আমার বেশি প্রিয় কে?
তিরিশে বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ। তার পর জসীমুদ্দীন (জসীম উদ্দীন)।
আপনার প্রথম বই তো বেরুলো ১৯৬৩ সালে। পাকিস্তান আমল। কিভাবে বেরুলো বইটা?
তখন অপরিচিত লেখকের বই প্রকাশ হওয়া কঠিন ছিল। লোক লোকান্তর। কয়েকজন তরুণ কবি ও সাংবাদিক নিজেদের পকেট থেকে চাঁদা দিয়ে ‘কপোতাক্ষ’ নামে একটা পাবলিকেশন করে বইটা বার করে। এটা আমার জীবনের একটা বড় প্রাপ্তি।
‘সোনালী কাবিন’ তো মুক্তিযুদ্ধের পরে!
হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধের পরে। ১৯৭৩ সালে।
‘সোনালী কাবিন’ আপনাকে প্রথম ব্যাপক পরিচিত দিলো।
হ্যাঁ। আমার অগ্রজেরা খুব প্রশংসা করে এই বইটার তখন। বিশ্বের যেখানেই গেছি বাঙালিরা আমাকে সোনালী কাবিনের কথা বলেছে। এটা আমারও প্রিয় কাব্য।
(এই পর্যায়ে কবি আবিদ আজম তাগাদা দেন, বসার ঘরে অনেক লোক, কবিকে সেখানে যেতে হবে)
মাহমুদ ভাই, বসার ঘরে যেতে হবে আপনাকে, অনেক সময় দিয়েছেন আমাদের। অনেক কথা রয়ে গেলো, আরেকদিন আসবো আমি, কথা হবে।
আচ্ছা। তুমি কষ্ট করে আমার কথা শুনলা, তাই তোমাকে ধন্যবাদ।
(ঈষৎ সংক্ষেপিত)
সংযুক্ত চিত্র: গুগল আর্কাইভ, শিমুল সালাহ্উদ্দিন
………………….
শিমুল সালাহ্উদ্দিন
কবি, সাহিত্য সংগঠক, মিডিয়াকর্মী
বিচিত্র এঙ্গেল থেকে প্রশ্ন তুমি করছো শিমুল। তৃষ্ণা জাগানিয়া। গ্রেট।
LikeLiked by 1 person