তখন আমরা কলেজে পড়ি। তখন একদিন একটা মিউজিক ভিডিও দেখি। একটা সিনেমার গান। ভিডিওগ্রাফিটার চেয়েও গানটার লিরিক ভয়াবহ সুন্দর। গানটার একটা লাইন ছিল, a kiss is not a kiss without your sigh. এটা কাসাব্লাংকা সিনেমার গান। তোমার দীর্ঘশ্বাস ছাড়া চুম্বন আসলে চুম্বনই হয় না— এই জাতীয় কথা আমাদের বুকের ভিতর হাহাকার হয়ে কাঁটার মতো বিঁধে যায়। আমরা সিনেমাটা দেখার জন্য খুঁজতে থাকি। কিন্তু শহরতলির ভিডিও-লাইব্রেরিতে সেটা অনেক খুঁজেও পাওয়া যায় না। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ফার্স্ট ইয়ারে সিনেমাটা আমরা খুঁজে নিয়ে দেখে ফেলি। না, সিনেমাটার মধ্যে গানটা নেই। ওটা আসলে সিনেমাটা নিয়ে বানানো গান। তবে সিনেমাটিতে আরেকটি গান আমরা পেয়ে যাই, As time goes by. এই গানটা আরো ভয়াবহ। আমরা শুনতে থাকি, And when two lovers woo/ They still say: I love you/ On that you can rely/ No matter what the future brings/ As time goes by… আমাদের বুকের ভিতর মাইলের পর মাইল ফাঁকা হয়ে যায়। অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত বিখ্যাত অ্যামেরিকান কম্পোজার ম্যাক্স স্টেইনারের সংগীত এই সিনেমাকে এমনই মহিমান্বিত করে।
সিনেমাটিতে প্রধান চরিত্রে রিক ব্লেইনের ভূমিকায় অভিনয় করেন হ্যামফ্রে বোগার্ট, ইলসার ভূমিকায় অভিনয় করেন ইনগ্রিড বার্গম্যান, নিগ্রো পিয়ানোবাদক স্যামের ভূমিকায় অভিনয় করেন ডুলি উইলসন এবং পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় অভিনয় করেন ক্লদ রেইন্স। এছাড়া ভিক্টর লাজলোর ভূমিকায় অভিনয় করেন পল হেনরিড।
যদিও কাসাব্লাংকা সিনেমায় হামফ্রে বোগার্টের অভিনয় এখানো সিনেমা সমালোচকদের কাছে আলোচনার বিষয় হয়ে আছে, তথাপি আমাদের কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে ইলসারূপী ইনগ্রিড বার্গম্যান। এই সিনেমা দেখেই প্রথম আমরা তার প্রেমে পড়ে যাই। সেই চাহনি, সেই চুম্বনের দৃশ্য, সেই অশ্রু বারবার টেনে টেনে দেখি। তারপর আরো অনেকবার সেই সিনেমা দেখেছি।
একদিন ইনগ্রিড বার্গম্যানের জীবনটা যেন ওলট-পালট হয়ে গেল ইতালিয়ান পরিচালক রবের্তো রসেলিনির প্রেমে পড়ে। তিনি একদিন মুগ্ধ হয়ে এক চিঠি লিখেছিলেন রসেলিনির কাছে। সেই চিঠিই কাল হয়ে দাঁড়ালো। তাদের মধ্যে প্রেম হলো। সেই সময় তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, মানুষ আমাকে জোয়ান অব আর্ক হিসেবে দেখে, সন্ন্যাসিনী মনে করে। আমি তা নই। আমি শুধু এক নারী, একজন মানুষই। সুইডেন থেকে ততোদিনে এসে তিনি বিস্তারিত হয়েছেন হলিউডে। হামফ্রে বোগার্টের সঙ্গে কাসাব্লাংকা ছবিতে অভিনয় করে সিনেমার ইতিহাসেই নিজের জায়গা করে নিয়েছেন তিনি।
১৯৪৩-এ আর্নেস্ট হেমিংওয়ের স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে লেখা উপন্যাস For whom the bell tolls সাহিত্যের পাতা থেকে উঠে আসে সিনেমায়। উপন্যাসটা পড়ার পরও সিনেমাটা আমরা একাধিকবার দেখে ফেলি কেবল ইনগ্রিড বার্গম্যানের জন্যই। সেই সিনেমায় মারিয়ার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ইনগ্রিড বার্গম্যান। ছোটো ছোটো করে ছাটা সোনালি চুলে মারিয়া রূপে তাকে দেখে আমরা বারংবার অস্থির হই, আবেশে বিবশ হয়ে যাই। জানা যায়, হেমিংওয়ে নিজেই ইনগ্রিডের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে তার উপন্যাস নির্ভর সিনেমায় তাকে নিতে অনুরোধ করেছিলেন প্রযোজক, পরিচালকের কাছে।
এখন আসি, কাসাব্লাংকা সিনেমার কথায়। আমরা জেনেছি, মানুষ বারংবার ভালোবাসাকে খুঁজে খুঁজে ফেরে জন্মাবধি। একসময় হয়তো সেই প্রেম এসেও ধরা দেয়। কিংবা তা অধরাই থেকে যায়। এইসব আসলে পরিগণিতই করা যায় না।
আমাদের চোখে ভাসতে থাকে চুম্বন করতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছে মদের গ্লাস। কিংবা রিকের বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে অবশেষে আবেষ্টনে ভেঙে পড়ছে ইলসারূপী সঘন প্রণয়। সেই রকম একটা প্রেমের সিনেমা কাসাব্লাংকা। সিনেমাটি ড্রামা, রোমান্স, ক্লাইম্যাক্স এবং সাসপেন্স সকল উপাদানে ভরপুর যেনো একটি ধ্রুপদী সংগীত।
কাসাব্লাংকা সিনেমায় নায়ক রিকের তার কাফে’র নিগ্রো পিয়ানোবাদক স্যামের প্রতি সেই অবিস্মরণীয় সংলাপ, you played it for her, you can play it for me সব এখনো আমাদের কানে বাজে। ইলসার শোনা সেই গান রিক শুনতে চায়।
মরক্কো’র কাসাব্লাংকা শহরেই বলা যায় করে সিনেমাটির মূল কাহিনি গড়ে উঠেছে। একটি বিয়োগান্তক প্রেম কাহিনি হচ্ছে সিনেমাটির উপজীব্য৷ শহরের এক কাফে’র মালিক ও তার পুরনো প্রেমিকাকে নিয়েই আবর্তিত হয়েছে সিনেমার গল্প। মেয়েটি তার স্বামীর হাত ধরে অ্যামেরিকার পথে পা বাড়ায়। এই চলার পথেই দেখা হয় পুরনো প্রেমিকের সঙ্গে। তার মন চায় কাসাব্লাংকায় থেকে যেতে। কিন্তু সঙ্গে যে তার স্বামী!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথমদিকে অ্যামেরিকান রিক ব্লেইন পালিয়ে আসেন কাসাব্লাংকায়। এখানে তিনি গড়ে তোলেন শহরের সবচেয়ে নামকরা কাফে, রিক্’স কাফে অ্যামেরিকান। যেখানে শহরের সব নামিদামি লোকজনের আনাগোনা। সেই সময় নাজিদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে অনেক শরণার্থীই আশ্রয় খুঁজছে অ্যামেরিকায়। আর অ্যামেরিকা যাওয়ার জন্য দরকার এক্সিট ভিসা যা পাওয়া যেতে পারে কাসাব্লাংকায়। ঘটনাক্রমে ট্রানজিটের দুটো কাগজ পায় রিক। তিনি জানতে পারেন যে একজন নামকরা চেক আন্ডারগ্রাউন্ড বিপ্লবী নেতা ভিক্টর লাজলো কাসাব্লাংকায় এসেছেন। আর তাকে ধরার জন্য খুঁজছে নাজিরা। একসময় রিক বিস্ময়ের সঙ্গে আবিস্কার করেন যে ভিক্টর লাজলো একজন নারীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন, যার নাম ইলসা। এবং তাকে রিক চেনেন।
রিকের পুরনো প্রেমিকা ইলসা। যার সঙ্গে ফ্রান্সের প্যারিসে চমৎকার সময় কেটেছিল তার, আবেগঘন উষ্ণ প্রেমের সময়। রিকের সঙ্গেই ইলসার যাওয়ার কথা ছিলো। যখন তিনি চলে আসার জন্য ট্রেনে উঠছিলেন ঠিক সে সময় ইলসা চিঠির মাধ্যমে তার অপারগতার কথা জানান। সেই প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ইলসা এসে যখন রিকের সাহায্য চায় তখন রিক গোপনে লাজলো আর ইলসাকে পালাতে সাহায্য করেন। শেষসময় এমন একটি মুহূর্ত আসে যখন রিক বললেই ইলসা তার কাছে থেকে যেতেন। সিনেমাটির সবচেয়ে নীরব উত্তেজনাপূর্ণ এই দৃশ্যটি এখনো আমাদের চোখে অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।

১৯৪২ সনে নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৪৩ সনের ২৩ জানুয়ারি। এটি একটি হলিউড মাস্টার-পিস। সিনেমাটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম জনপ্রিয় চলচ্চিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। পরিচালনা করেছেন হাঙ্গেরিয়ান পরিচালক মিশেল কারিজ। সিনেমাটি সেরা সিনেমা, সেরা ডিরেক্টর এবং সেরা কাহিনি ও চিত্রনাট্যের অস্কার পুরস্কার জিতে নেয়। এর বাইরে আরো আটটি ক্যাটেগরিতে অস্কার নমিনেশন পেয়েছিল সিনেমাটি। ১৪২ মিনিটের শাদা-কালো এই সিনেমার মূল কাহিনি নেয়া হয় এভরিবডি কামস টু রিকস নাটক থেকে। লিখেছেন মারে বার্নট ও জোন অ্যালিসন। চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন জুলিয়াস ইপস্টন, ফিলিপ ইপস্টন এবং হাওয়ার্ড কোচ।
অ্যামেরিকান ফিল্ম ইন্সটিটিউট বিশ্বের সেরা ১০০ রোমান্টিক সিনেমার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। তালিকাটির এক নম্বরে আছে যে সিনেমাটি তার নাম কাসাব্লাংকা। ২০০৭ সনে লস অ্যাঞ্জেলেসের অ্যামেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউট একটি জরিপে জানিয়েছে যে, গত ১০০ বছরে যদি তিনটি শ্রেষ্ঠ ছবির নাম করতে হয় তাহলে নিঃসন্দেহে কাসাব্লাংকা হবে তাদের মধ্যে একটি। আমাদের কাছেও আমাদের দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তিনটি সিনেমার একটি। প্রেমকে বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে যদি বর্তমান সমাজকেও ব্যাখ্যা করা যায় তাহলে সেই প্রেম হয়ে ওঠে মহৎ যেটা আমরা কাসাব্লাংকা’র মতো ছবিতে খুঁজে পাই।
অ্যামেরিকান প্রেমের ছবি হিসেবে কাসাব্লাংকা’র নাম শুরুর দিকেই পাওয়া যায়। পরে আরো অনেক সিনেমাই নির্মিত হয়েছে কাসাব্লাংকা’র অনুকরণে। আজো মরক্কোর শহরটির পরিচিতি আছে মুভিটির কারণে। অনেক পর্যটক সেখানে ঘুরতে গেলে খুঁজে বেড়ান একটি কাফে, যার নাম রিক্’স কাফে অ্যামেরিকান।
৭০ বছর আগেকার সিনেমা। কিন্তু আমাদেরকে এখনো সেইরকমই তাড়িত করে সবর্ত্র।
……………….
