
সবসময় আমি আমার নিজের কবিতা লিখতে চেয়েছি। একেবারে আমার কবিতা—আমার ঘামের গন্ধে ভরা, আমার অভ্যাসে আক্রান্ত, আমার ব্যক্তিসত্ত্বায় আচ্ছন্ন। তাই পৃথিবীতে প্রচলিত কবিতার যে-সংজ্ঞাগুলি আছে, কিংবা সমালোচকেরা যে-সব রাস্তা দেখিয়েছেন—আমার কবিতা তাদের মতো না হলেও আমার কিছু আসে যায় না। আমি আমার কবিতাই লিখবো এবং আমি যে-কবিতা লিখবো, সেটা আমি ছাড়া আর কেউ লিখতে পারবে না। কবিতা লেখার শুরুর দিনগুলিতে আমি এভাবেই আমার যাত্রাপথ ঠিক করতে চেয়েছিলাম। কেননা, কোথাও যেতে চাইলে একটা প্রেরণা, একটা উদ্যমতা লাগেই। আর কবিতার যাত্রা সব সময়ই অথই সমুদ্রের ওই পাড়ে কী আছে, প্রাচীন নাবিকদের এই চিরকালীন
জিজ্ঞাসার মতোই। জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে, অজানা সব অভিজ্ঞতার মুখামুখি দাঁড়িয়ে তাকে চিনতে হবে। চেনা অভিজ্ঞতার শক্তি দিয়ে সম্পর্ক তৈরি করতে হবে নতুনের সাথে আর পুরানো নাবিকদের গল্পে যোগ করতে হবে নতুন অনুচ্ছেদ—এসবই জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়া নাবিকের মতো কবিরও সম্বল এবং কাজ।
আমার সম্বল তৈরিতে আমার চেয়ে পুরানো নাবিকদের মতো আমার আগের পৃথিবীর অগ্রজ কবিদের অবদান ছিল অপরিসীম। তারা না থাকলে আমার নিজের কবিতার কথা ভাবার মতো সুযোগ এবং সামর্থ কোনটাই আমার থাকতো না। আমি তো এমন কোনো পৃথিবীতে জন্ম নেইনি, যেখানে কবিতা নামের কোনো বস্তুকে কেউ চেনেই না? বরং একটা ছোট্ট জৈব অনুর জটিল দেহের প্রাণী হয়ে ওঠার মতো কবিতাও তার পার্থিব জীবনে অনেক সমৃদ্ধ, অনেক ছড়ানো। আমার সামনেও তাই ছড়ানো ছিল আমার আগে অভিযানে যাওয়া নাবিকদের আঁকা মানচিত্রগুলির সব অনুলিপির মতো অগ্রজ কবিদের কবিতার স্তুপ। আমি সেই স্তুপের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করেছি কবিতা অভিযানের কলাকৌশল ও টেকনিক্যাল বিষয়গুলি। মানুষ তার অর্জিত জ্ঞান লিখে রাখেতো এই সহায়তাটুকু দেবার জন্যই। এগিয়ে যাবার জন্য এই সহায়তা, এই আলোটুকু হাতে ধরিয়ে দিয়ে জ্ঞানই তো বলে দেয়, যাও বাছা এবার নিজের পথ ধরো।
আমাকেও ওই অগ্রজ কবিতার স্তুপ এই কথাই বলেছিল। শিখিয়েছিল ‘ধূ ধূ নীল মরুভূমি’ সমুদ্রে জাহাজ চালানোর কৌশল। তবে তাদের দেয়া যে-পরামর্শটা ছিল সবচেয়ে জরুরী, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো, অভিযানে বেরুতে হয় খালি হাতে। এই পরামর্শটা আমিও দিতে চাই আমার পরে আসা কবিদের। দীর্ঘদিন কবিতার অভিযানে লিপ্ত থেকে আমিও বুঝেছি এর চেয়ে সত্য পরামর্শ আর নেই।
কবিতার জাহাজ চালানোর কলাকৌশল পৃথিবীর সব কবিই নিজের নিজের কবিতায় লিখে রাখেন। অর্থাৎ, কবিতা কিভাবে লিখতে হয়, একটা কবিতাই তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। একটা সিনেমা দেখতে গিয়ে দর্শক যেমন আবেগে আপ্লুত হয়, চলচ্চিত্রকর্মী সেভাবে হয় না। সে দেখে সিনেমাটির নির্মাণপদ্ধতি, বিভিন্ন কলাকৌশলের প্রয়োগ, এইসব। কবিতাতেও এই ঘটনা ঘটে। কবিতার শরীরে শরীরে উল্কির মতো ফুটে থাকা এইসব নির্মাণকৌশল জড়ো করে এদের সাধারণীকরণের কাজটা করে সমালোচকরা। দাঁড় করায় তত্ত্ব। এসব তত্ত্ব মূলত কবিতার শারীরিকতাকে চিনতে সাহায্য করে। বোঝা যায় ক্রাফটম্যানশিপের ব্যাপারটা কবিতায় কিভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব। এটাই কবিতার জাহাজ চালানোর কলাকৌশল এবং কবিযশোপ্রার্থী কেউ কবিতার শরীর থেকেই আয়ত্ব করে এটা। কিন্তু তার আগে ওই যশোপ্রার্থীকে যে-কোন ছাত্রের মতোই অর্জন করতে হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। আর সেটা অর্জিত হয় নিজের কল্পনাশক্তিকে শাণিত করার মাধ্যমে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে গিয়ে আমি নিজে দেখেছি, কিভাবে পড়তে হয় সেটাই শেখায় ইনস্টিটিউটগুলি। তারপরে ছেড়ে দেয় পৃথিবীর বিস্তীর্ণতায় শেখা জিনিসের প্রয়োগকৌশল রপ্ত করার জন্য। অর্থাৎ, প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে বের হওয়া মানে পড়াশোনার শেষ না বরং শুরু। এবং বাকি জীবন এই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে আর শিখতে হবে থিওরি এবং অ্যাপ্লিকেশনের তফাৎ।
আমাদের প্রচলিত ছড়া, গান, রূপকথা—যারা শিশুতোষ জীবনে আসে নতুন কোন খেলনার মতো, তা দিয়েই হয় আমাদের ব্যক্তিগত কল্পনার অঙ্কুরোদ্গম। আর সে-সময় যে-চারা জন্ম নেয়, তাকে কৃষকের যত্নে বড় করে তুলতে পারলেই আসে কল্পনার স্ফুর্তি। সেই স্ফুর্তি কল্পনাকে সাহস দেয়, প্রশ্রয় দেয়, এগিয়ে দেয় অজানা ও অচেনার দিকে। কিন্তু কল্পনার চারার যত্নে ভাটা পড়লে সে নেতিয়ে পড়ে এবং সোজা হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এতে যার কল্পনা শুকিয়ে গেল, তারই ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি, কারণ যে-কোন কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবার ক্ষমতা তার নষ্ট হয়ে যায়। পাশাপাশি সম্ভাবনা নষ্ট হওয়ার কারণে কিছু ক্ষতি তো সমাজেরও হয় নিশ্চয়ই। কল্পনা ছাড়া মানুষ তার বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীত এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে পারে না। সমাজ পারে না তার সবটুকু শক্তি ব্যবহার করে সামনে যেতে। তবে ‘অপচয় পৃথিবীতে চিরকাল আছে’।
কবিতার যাত্রায় জাহাজ চালানোর কৌশলের সাথে এই কল্পনার স্ফুর্তিরও দরকার হয়। এটাই কবির সবচেয়ে বিশ্বস্ত দিকদর্শনযন্ত্র। একটা অসামান্য শক্তিশালী কম্পাস, যে শুধু পথই দেখায় না বরং পথকে এনে দেয় হাতের মুঠায়, নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায় যাবতীয় চারপাশকে। তখন মহাসমুদ্রের মহাঢেউকেও মনে হয় নাগরদোলা। ঢেউয়ের মাথায় চড়ে আকাশকে জাপটে ধরার আকাঙ্ক্ষা হয় প্রবলতর।
কবিতার জাহাজ চালানো শুরু করে আমিও হয়ে উঠলাম ঢেউয়ের নাগরদোলায় চড়ে আকাশের কোমর জড়িয়ে ধরার আকাঙ্ক্ষায় মশগুল, আর এতে আমাকে সবচেয়ে সাহস আর সমর্থন দিয়েছিলেন বিনয় মজুমদার এবং শার্ল বোদলেয়ার। আমি আজো এদের সাহস আর সমর্থন নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াই। আহা, আমার কী উপকারটাই-না করেছিলেন বুদ্ধদেব বসু তাঁর শার্ল বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা বইটা লিখে! এরকম পাঠ্যপুস্তক আমি জীবনে আর পাইনি। পরে জীবনানন্দের কবিতার কথা এবং সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবি শ্রী জীবনানন্দ দাশ বই দুইটাও আমাকে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
আসলে, কবিতার চেয়েও কবিতা বিষয়ক গদ্য আমাকে উত্তেজিত করেছে অনেক অনেক বেশি। বিশেষ করে কবিদের লেখা গদ্য। এসব গদ্যে থাকে নানরুটির নিজের লেখা আত্মজীবনী, থাকে তন্দুরের তাপের বর্ণনা।
নানরুটিকে আমার সব সময় মনে হয় নরকের ফুল। যমদূতের মতো নানরুটির কারিগর একটা নিষ্পাপ আটার গোলাকে ছুঁড়ে দেয় নরকের আগুনের মতো লাল তন্দুরের ভিতরে, আর অকথ্য সব যন্ত্রণা সয়ে সেই আটার গোলা ফুটে ওঠে ফুলের মতো। বোদলেয়ারের ক্লেদজ কুসুম বোধহয় এরাই, এদের মতো মানুষেরা। আর এসব ভাবতে ভাবতেই আমার মনে হয়, রাঁবোর নরকে এক ঋতু বোধহয় নরকে একটা ঋতুর কথা না, বরং নরকে একটাই মাত্র ঋতু, এক প্রবল গ্রীষ্মকাল—এই কথার অব্যর্থ ঘোষণা। রাঁবোর মতো তরুণের পক্ষেই সম্ভব এই অমোঘ সত্যের বিউগল বাজানো।
কবিতা লিখতে লিখতে আমি টের পেয়েছি, বিষয় আবিস্কার করাই সবচেয়ে বড় ঘটনা। ভাষা দুঃশ্চিন্তার কোন বিষয়ই না। কেননা, সব বিষয়ই তার নিজের ভাষা নিয়ে আবির্ভূত হয়। আমি বাঁশঝাড় নিয়ে কোনো কবিতা লিখলে, সেখানে ঝরে পড়া বাঁশপাতা, শেয়াল ও মানুষের গু প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে আসবে কলমের ডগায়। আর যদি তা না আসে, তাহলে বুঝতে হবে নির্মাণটা কৃত্রিম অথবা বাঁশঝাড় এই কবিতায় নাই। এখন এই কবিতা বরিশালের ভাষায় লিখলেই কী, আর চট্টগ্রামের ভাষায়? বাঁশঝাড়ের আত্মাকে চেনানোইটা তো আসল! কবিতা কম্পাস ছাড়া আর কি? এই কম্পাস আত্মার খোঁজ দেয়। আর আত্মা মানেই তো আত্মকথা। আর আত্মকথা মানে এমন এক সমুদ্যত স্বর, যার অনুবাদ দুঃসাধ্য। তার চারপাশের প্রকৃতি, যার মধ্যে অনন্তকাল টিকে থেকে সে অর্জন করেছে টিকে থাকার কৌশল—সেই প্রকৃতিই তার সমস্ত ইঙ্গিতের মূর্ত বাসনার মূর্তি তৈরি করে দেয়। আর কবি তো সামান্য দর্শক এবং কথক মাত্র।
কবিতা লিখতে গিয়ে আমি স্পষ্ট বুঝেছি, পথ হাঁটা শুরু করার সময়কার এক বিরাট কবি পথ হাঁটতে হাঁটতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে পড়ে।
লেখক-পরিচিতি:
।অমিতাভ পাল। কবি, গল্পকার, গদ্যকার। জন্ম ১৯৬২। কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক। পেশা: মিডিয়াকর্মী।