কবিতা নিয়ে এক ধরনের বোঝাপড়া আসলে কোনো কাজের কথা না। কবিতা নানান রকম, সেটা অনেক কৃতীজনের মুখে আপনারা অনেক শুনে থাকবেন। এই অনেক রকম কবিতার বিষয়টা যে টানা হলো, তার কারণ, নকীব ভাই’র কবিতা অনেক রকম। উনাকে শুরু থেকে সম্প্রতিতে যেভাবে পড়েছি, কিংবা মিসেস নিতিয়ার সাথে বৃষ্টি এলো যেদিন-এ, অথবা কালো কাচের বাইরে কিছু আর ঘটে না—প্রতিবার এই অনেক রকম কবিতার ব্যাপারটা আঘাত করে। আড়ম্বরহীনতাই সম্ভবত আহমেদ নকীবের কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। আবেগপ্রবণ প্রগলভতাকে তিনি সচেতনেই হয়ত ইগনোর করেন, যে-কারণে উনার কবিতা পাঠে সব সময়েই একটা বৈঠকী আলাপের ঢং পাওয়া যায়, আর সেই সাথে নাগরিক জীবনের খুব নিয়মিত ঘটনাও খুব সহজে উনি কবিতার আড়ালে আমাদের বলতে থাকেন। এবং এই-যে উনার বিড়াল, এই-যে উনার গ্রীন রোডের বাসা, কিংবা আজিমপুর, উনার বাবা, মা, খালু, লুনা ভাবী (উনার স্ত্রী)—সবাই উনার হাত দিয়ে কবিতা হয়ে উঠতেছেন, সেইটা একটা ইন্টারেস্টিং জায়গা আমাদের মত পাঠকদের জন্য। বিন্দু ম্যাগাজিনে কিছুদিন আগে উনার একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। সেইখানে উনি বলতেছিলেন কবিতা লিখতে গিয়ে উনার কোনো আইডিয়া কাজ করে না, বা সচেতনভাবে আইডিয়া উনি বর্জন করেছেন কবিতায়। বা সে-আইডিয়াগুলাকেও ভাঙছেন, বৃষ্টি বা বিড়াল নিয়ে যেমন। এইখানে একটা তেমন এন্টি-আইডিয়া কবিতা-পাঠক পড়বেন। যদিও আমার কাছে শেষ পর্যন্ত আহমেদ নকীবের সবচেয়ে শক্তির জায়গা লাগে তাঁর কবিতার মাঝ দিয়েও সাসপেন্স তৈরি করে তোলার ক্ষমতা বা কবিতায়ও কোনো কোনো চরিত্রকে তৈরি করা, তাদের সাথে মিনিংফুল কনভার্সেশান করে করে পাঠককেও একটা ইনভ্লভমেন্টের মাঝে নিয়ে যাওয়া।
পাঠক হয়তো দেখবেন এই কনভার্সেশনের মাঝেই অনেক রাজনীতি ঢুকে পড়তেছে। করোনাকালীন সময়ে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওলার মিলিত সংকটে তাল তাল মেঘও হয়তো আপনারা ভেঙে পড়তে দেখবেন। নিছক আবেগ নয়, বরং জীবন ঘনিষ্ঠ, রেলেভেন্ট একটা জায়গা থেকে আসলে কবিতাকে ডিল করার উদাহরণ কবি আহমেদ নকীব উনার এই পান্ডুলিপির কবিতা থেকে আমাদেরকে আবারও দিচ্ছেন বলে বোধ হয় । আশির দশকে যারা কবিতা লিখেছেন, তারা নানান ভাবেই বাংলা কবিতার পরবর্তী সময়কে প্রভাবিত করেছেন। আহমেদ নকীবও ব্যাতিক্রম নন, বরং তাদের মাঝে উজ্জ্বলতম। তুলনামূলক তৎসমঘন কবিতার একটা পরিব্যাপ্তি তো সে সময়ে ছিল বা এখনো আছে বলে মনে হয়। সেইখান থেকে আলাদা নগর ঢাকার একটা ভাষা, নগর ঢাকার একটা টুকরো তাঁর লেখায় পাঠক সব সময়েই পেয়েছে। নানান রকম কবিতার জগতে আহমেদ নকীবের পক্ষ হয়ে আপনাদের আমন্ত্রণ জানায় রাখলাম এই পান্ডুলিপির কবিতাগুলো পড়ার।— ফয়সাল আদনান
তালতাল মেঘ ভেঙে পড়ছে আমি আর ফেরদৌস হাসান আক্ষেপ করছিলাম, কিভাবে বাড়িভাড়া না দিয়ে চলে গেলো আমাদের ভাড়াটিয়া সব ঠিক আছে, আমরা মালিক, ৫২ বছর আগের বাড়িগুলির, এমন গর্তঅলা গলি'র মধ্যে একবার বড় মামা পা হড়কে পড়ে গেলেন, আর বলছিলাম আমাদের ভাড়াটিয়ারা এখন আর টেলিফোন রিসিভ করছে না আর হঠাৎ স্বপ্ন দেখছি চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়ছে জবুথবু বাড়িটা'র তিনি বিড়বিড় করছেন আর বলছেন, এবার তোমরা আমাকে চিরদিনের জন্য ছুটি দিয়ে দাও কিন্তু আমাদের আপার অনেক প্রিয় বাড়িকে কিভাবে কবর দিবো আমরা? শুনেন, শুনেন, ওরা তো বলতেই পারতো ওদের এখন বিপদ, নাকি ওরা টাকা'র পোটলা বগলে চেপে ধরে ঢাকা থেকে কেউ সিরাজগঞ্জে কেউ ঠাকুরগাঁও চলে গেছে, একেবারে চলে গেছে? তখন টাকাগুলির দমবন্ধ হয়ে আসছিলো টাকাগুলির মরণ হয়েছে আরো বহুযুগ আগে আর যখন মৃত্যুকে ঠেকানো যাচ্ছে না, টাকার উপর সব রাগ জমা হলো আমাদের, আমরা পকেটের টাকা সব ছিটিয়ে দিলাম রাস্তায় রাস্তায় আর টাকাগুলি ভুতুড়ে হাতের নিষ্পেষণ থেকে এবার মুক্তি পেলো, নির্ভার টাকারা দলে দলে উড়ে গেলো অনেক দূরের আকাশে তারা বালি হাঁস হয়ে এবার ফিরে আসবে সাইবেরিয়া থেকে জাহাঙ্গীরনগরের লেকে আমাদের সন্দেহের চোখ ঘুরঘুর করছে সেলফোনে কথা বলতে বলতেই চোখগুলি কোটর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় গড়িয়ে যাচ্ছে ফরিদ আর রুবেলকে গর্ত থেকে বের করে আনবেই আনবে এবার যা থাকে কপালে হায় আমাদের চোখগুলির পাওয়ার কমে গেছে, কে দিবে একটা মোটা কাচের চশমা এই যাত্রায় আমাদের, কে আছো ব্রাদার? একটু আগে সরকার কনফার্ম করলো, সব বানোয়াট আর মিথ্যা কথা, প্রধানমন্ত্রীর দফতর দুই মাসের বাসা ভাড়া মওকুফ করার জন্য কোনো নোটিশ দেয় নাই, আমার আর হাসানের জানে পানি আসছে আর চকচক করছে আমাদের চোখ আর আমরা প্ল্যান করছি এবার ভেঙে ফেলবো আমানতের সব বড়সড় টাকা, মাছের টুকরার মতো ডিপ ফ্রিজে সাজিয়ে রাখবো সেইসব টাটকা নোট মাথার উপর তালতাল মেঘ ভেঙে পড়ছে আর এদিকে কল্লোল হাসপাতালের বেড থেকে গা শিউরে ওঠা একটা কথা ছুঁড়ে দিলো: বিডিআর-এর ঘটনার মতো ঘটনা ঘটতেও পারে, বাসায় ঢুকে লুটপাট হতে পারে আর কোটিপতিদের নিকুচি করছে কল্লোল আর ইউকে'র অর্থনীতি চাঙা হতে ৬ মাস লাগবে আর আমরা তো কোন তলানিতে আছি, আমাদের দরজাগুলি খুলে নিয়ে যাবে ক্ষুধার্তরা আর আমরা কবেকার বেতঝাড়ের গর্ত থেকে ঝাঁকঝাঁক কাঁটাঅলা শজারুরা বেরিয়ে আসলাম ফেরদৌসকে বলেছি, দেখে রাখিস তো আম্মার বাড়িটা, দেখে রাখিস তো কাচগুলিকে যেখানে তুই একদিন ঢিল ছুঁড়ে গর্ত করে দিয়েছিলি, রোদের বুদবুদগুলিকে শার্শি'র বুকের মধ্যে আলতো করে তুলে রাখিস ওদেরকে ঘোর কুজ্ঝটিকার মধ্যে ছেড়ে দিবো যেনো আব্বা আর খালু আজিমপুর থেকে রাস্তা চিনে সহজেই বাসায় ফিরে আসতে পারে ২০/০৪/২০২০ ডামি বৃষ্টি বৃষ্টি যে রিমঝিম এটা কবিরাই বলে কবিরাই দলবেঁধে বৃষ্টির দিকে বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকে আর বৃষ্টিকে ন্যাংটা ক'রে ফেলে কান খাড়া করে রাখে– বৃষ্টি কি টিপটিপ ক'রে পড়ে, নাকি ঝিরঝির, নাকি তেড়চা বৃষ্টি নিয়ে বেশ কানাঘুষা চলে পারলে তো কবি নিজেই বৃষ্টি হয়ে তেড়ে যায় বৃষ্টির দিকে খপ করে ধরার জন্য তার ফোঁটা কি এক কাণ্ড, বৃষ্টিকে হ্যান্ডেল করতে গিয়ে তার জামা-কাপড় ভিজে জবজবে এখন যে বৃষ্টি ঝরছে সে হচ্ছে ডামি বৃষ্টি, বৃষ্টির মতোই কিন্তু বৃষ্টি না কবি তাই নকল এক বৃষ্টির বন্দনা করে ২৩/১০/২০২০ রুহু এঁদো বাড়ি, এঁদো বাড়ি আমার রুহু তোমার ভাঙা কপাট দিয়েই বানানো তোমার নিমগ্ন বালতিতে যে ময়লা রাখা আছে আর ওখানে মুখ দেয় একটা মিটিমিটি বিড়াল সেইখানে আমি-ই মুখ রাখি বিড়ালের বেশে যে কাগজগুলি বৃষ্টির পানিতে চুপসে আছে আর কালো কালিতে লেখা আবছা অক্ষরগুলি একটার সাথে আরেকটা জড়ানো, সেই লেপ্টানো অক্ষরে ঢুকে বসে থাকি আম্মা, আপনি যদি ভেজা কাগজ-গুলিকে রোদে শুকাতে দেন তবে আবার ফিরে পাই বাক-শক্তি আমি তখন আম্মার গান গলা ছেড়ে গেয়ে উঠি এঁদো বাড়ি, এঁদো বাড়ি আমার রুহু তোমার ভাঙা কপাট দিয়েই বানানো ১৮/০৮/২০২০ আমাদের হারানো যৌনাকাংখা আমাকে নাহিদা বানু লুনা হনুমান নামে ডাকে আর মনে পড়ে ঝিনাইদহের কথা যেখানে হনুমানেরা একবার থানা ঘেরাও করেছিলো আমিও কি সেই হনুমানদের একজন ছিলাম আর লুনাও কি ছিলো হনুমানি বউ আমার আর গোসল করতে গেলে প্রায়ই আমার মনে পড়ে ভুলে পানি খাওয়া হয় নাই এবার যখন আধা-নগ্ন হয়ে আমি পানি পান করি নাহিদা বানু আমাকে পানি দিতে পেরে বেশ মজা পায় আর বলে, ওরে আমার হনুমান ব্যাটা আর এই হনুমান ডাকার ভিতর দিয়ে কি আমাদের হারানো যৌনাকাংখা আবার ঝাপ দিয়ে আসে শীতল রক্তের বীজে তবে সেই পানি আর গতরে থাকে না ব্যাংকের লোকেরা সমস্ত পানি গা থেকে বের করে নিয়ে যায় আমার হনুমানগিরি তবে আবার কবে উদয় হবে বলো তো মিসেস নাহিদা বানু লুনা ০২/০৭/২০২০ ৩৪ বছর পর আলমডাঙার একটা মেয়ে ভেসে এলো ৩৪ বছর পর এবার মুখোমুখি বসলাম মেয়েটার আর বললাম আপনি বাবলার ডালে হলুদ পুষ্প হয়ে ফুটেছিলেন আর কেউ কি চেয়েছিলো কাঁটা হয়ে জন্ম নিতে ঢেউ ঢেউ সেই আলমডাঙায় আপনাদের বাজারে ইন্ডিয়ান কেওকারপিন তেল উপুড় হয়ে বোতল থেকে ঢকঢক ক'রে পড়ে গেলো আর আপনি মনেই করতে পারলেন না সেই ঘটনাটা মেয়ে আমার দিকে খুব অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকালো, দেখলাম চোখ তার পানির বুদবুদ হয়ে একবার ভেসে উঠছে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে আর তার চুলগুলি একঝটকায় দমকা বাতাসে উড়ে গেলো চাইলাম চুল ধরে আমিও তার সাথে উড়তে থাকি যদি আবার আলমডাঙায় অবতরণ করা যায় আর যদি আম্মাকে লেখা চিঠিটা গোলাকার বাংলোর ড্রয়ারে খুঁজে পাই ছিলো নাকি কোনো এয়ারপোর্ট স্বপ্নের সেই বাবলার বনে তবে মেয়ে আজ আর পুষ্পরূপে নাই এখন সে নিষিক্ত হয়েছে নূতন এক থোকা ফল জন্ম দেয়ার জন্য যতই বলি ঘোড়ার গাড়িগুলি কই? সে এবার হা করে তাকিয়ে থাকে আমি তো এরকম রাস্তা দেখি-ই নি এই কথা বলতে বলতে মেয়েটা হাওয়ায় উড়ে চলে যেতে থাকে শুনেন, শুনেন, আপনাদের ওখানে কাঠবিড়ালিগুলি দু-পেয়ে মানুষ ছিলো আর একটা পুরানো বাড়ির সিনেমা হলে আমি আর আপনি সিনেমা দেখেছিলাম ভাসমান কেদারায় বসে আর সেখানে কোনো দর্শকই ছিলো না আর একটা ঘোড়ার গাড়ি ভুল করে ঢুকে পড়েছিলো সিনেমার পর্দা ভেদ করে আলমডাঙার একটা মেয়ে ভেসে এলো ৩৪ বছর পর ২১/০৭/২০২০
। তালতাল মেঘ ভেঙে পড়ছে। আহমেদ নকীব । প্রকাশক: উড়কি। প্রকাশকাল: মার্চ, ২০২১ ।