“The weeping of the one who weeps
with an eye whose tears flows endlessly
is not enough to lament the loss of such as Cordova
My heart is torn apart for its wise
and forbearing men, it’s men of
Letters and its men of taste” — Ibn Shuhaid, 11th century
জ্যোৎস্নাস্নাত রাত, পাহাড় বেয়ে নেমে আসা রাস্তার দুই ধারে হাজার তারার মত জ্বলছে ঝাড়বাতি গাছে গাছে। যেন পাহাড়ের বুকে তারকাখচিত শহর ঘুমায় আকাশে হেলান দিয়ে। কী এক কাব্যিক, ঐশ্বরিক সৃষ্টি। দৃষ্টিনন্দন শহর-সৃষ্টির এই সিদ্ধান্ত, এই আলোকসজ্জিত নগরায়নের উদ্ভাবন আজকের নয়, আজ থেকে শত শত বছর আগের একজন আবদ-এর-রহমানের (730 A.D.) দূরদর্শিতার ফসল । সেই স্বপ্ন ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা। স্বপ্ন ছিল তাঁর প্রিয় নগরী গ্রানাদা, কর্দোভা, আন্দালুসিয়া প্রজ্জ্বলিত মুখ নিয়ে, অনন্য সেরা শহর হয়ে বিশ্বের বুকে সাম্যবাদের বার্তায় মুখরিত থাকবে চিরকাল। মাথা উঁচু করে ঘোষণা করবে তার অস্তিত্ব আর মানবতার বাণী।
স্বপ্নদ্রষ্টা আবদ-এর-রহমান মানবতা, উৎকর্ষ আর স্বর্গীয় পৃথিবীর স্বপ্নবীজ ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন জন লেননের ড্রিমারের মতই: ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের বাইরেও যারা মানুষ তাদের চোখে। বপন করে গিয়েছেন তাঁর আদর্শ, চির প্রত্যাশিত কর্দোভা, আল-আন্দালুস তথা স্পেনের সমগ্র অস্তিত্বে , যেখানে এক সময় বইতো সুগন্ধি ফোয়ারার জল। আইরিস-ভায়োলেট-পিওনি-বিছানো ঘাসে, বাতাসে মৌ-মৌ করতো কমলালেবু আর বাতাবী লেবুর সুঘ্রাণ। যেখানে মুসলমান, ক্রিশ্চান, ইহুদী সম্প্রীতির ভিতর বাস করতো, করত শিক্ষা-সংস্কৃতির আদান-প্রদান। চর্চা হত উচ্চমার্গের সাহিত্য, গণিত, ত্রিকোণমিতি, চিকিৎসাশাস্ত্র ও স্থাপত্যের। চর্চা হতো জলসেচন আর বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে। প্রকৃত অর্থেই প্রতিটি ঘর যেখানে ছিল সবার আকাঙ্ক্ষিত নীড়! যেখানে বাড়িতে থাকত আলো, বাতাসঘেরা সবুজ উঠান, ফুলসজ্জিত বাগান আর ফড়িং-ওড়া সুগন্ধী শান্ত ঝর্ণাধারা। সুনিপুন সৃষ্টিশীলতায়, রোমান্টিক আমেজে বাতি দিয়ে যেখানে ঘর জুড়ে যেত ঘরের সাথে, শহরের সাথে শহর, শহরের সাথে নদী, নদীর সাথে প্রকৃতি, প্রকৃতির সাথে সংস্কৃতি। হ্যাঁ, আমি গৌরবময় মেডিইভাল স্পেনের কথা বলছি। বলছি সেই আবদ-এর-রহমানের’র স্পেন — নাগারা’র দেশ, গোয়ার্নিকা’র দেশ, গ্যঁয়া’র দেশ, এন্টনি গাউদি’র গর্বের দেশ স্পেনের কথা।
সুঘ্রাণ আর রোমান্টিকতা তৎকালীন স্প্যানিশ স্থাপত্যচর্চায় এক অত্যাবশ্যকীয় আশ্চর্য সংযোজন। শোনা যায় পরিব্রাজকরা এখানে এসে মুগ্ধ হত সুবাসিত শহরের আভিজাত্য আর মোহিনী রাতের আলোকসজ্জায়। শহরকে সুবাসিত করার বিভিন্ন প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে ছিল ফোয়ারার জল আর জলসেচনে সুগন্ধী আতরের ব্যবহার। বাগানে-বাগানে, পথে-পথে গোলাপ, কমলালেবু, বাতবীলেবু আর নানা সুবাসী ফল-ফুলের চাষ। গ্রানাদা, কর্দোভা, আন্দালুসিয়া ধ্বংস হয়ে গেছে আভ্যন্তরীণ কোন্দল আর গৃহযুদ্ধে, কিন্তু স্বপ্ন বেঁচে আছে, বেঁচে থাকে। যুগে যুগে রক্তের মত সৃষ্টিশীলতাও প্রবাহিত হয় প্রগতিশীল মানুষের মননে, স্থাপত্যে, কাব্যে, শিল্প-সংস্কৃতিতে। তাই তো সারা পৃথিবীতে সুঘ্রাণের মত ছড়িয়ে আছে চিরবহমান সেই অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। আজও এক প্রেমিক তার প্রেমিকাকে নিয়ে ঘর বাঁধতে চায় সেই রোমান্টিক নির্মাণশৈলীর আদলে। আজ সেই স্বপ্নের গলিতে হাঁটতে হাঁটতে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা জনপ্রিয় সেই স্প্যানিশ আর্কিটেকচারাল স্টাইল নিয়ে কিছু কথা বলি ।
বিভিন্ন সময়ে বহু বছর ধরে “স্প্যানিশ আর্কিটেকচার” বহুবিধ উৎস দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। সঙ্গত কারণে, “স্প্যানিশ আর্কিটেকচার এবং বিল্ডিংশৈলী” যাকে বলে, তার কোনও সহজ উত্তর বা সংজ্ঞা নেই। মন্টেরি, মিশন স্টাইল, মরিশ স্টাইল —স্প্যানিশ স্টাইলে নির্মিত স্থাপনাগুলো নিয়ে গবেষণা করলে এই সমস্ত টার্ম শোনা যায়। বিভিন্ন শৈলীর বা ধারাগুলোর উৎপত্তির কারণ হ’ল ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় স্প্যানিশ নকশায় নানাবিধ প্রভাব আর্কিটেকচারকে যুক্ত করেছে, মুক্ত করেছে, প্রসারিত করেছে এবং বদলেছে। কিন্ত তারপরও সৃষ্টি হয়েছে তার নিজস্ব স্থাপনার ধারাবাহিকতা, সৌন্দর্য আর উৎকর্ষ। এই লেখাটিতে আমি আলোচনা করব স্প্যানিশ আর্কিটেকচারের সর্বগ্রাহ্য কিছু শৈলী এবং ধারা যা মূলত আবাসিক।
স্প্যানিশ স্টাইল রুফ বা ছাঁদ
স্প্যানিশ স্টাইলে মনকাড়া আইকনিক ব্যারেল রুফ যেন চিরচেনা সেই মাটির কাছাকাছি আপন পৃথিবীতে নিয়ে যায়। ছাদের এই টাইলগুলি সাধারণত কাঁদামাটির এবং মাটির উষ্ণ রঙগুলিতেই পাওয়া যায়। প্রচলিত বাড়িগুলিতে এই ছাদগুলি টেরাকোটা বা কাদামাটি এবং স্লেট থেকে তৈরি করার কারণ ছিল উভয় উপকরণের তীব্র উত্তাপ সহ্য করার দক্ষতা এবং দৃঢ়তা। যদিও বর্তমান সময়ে এই টাইলগুলি কংক্রিট থেকেও তৈরি করা যায়, কিন্ত পোড়ামাটি এবং স্লেটের ছাদগুলি পরিবেশবান্ধব এবং ব্যতিক্রমীভাবে টেকসই ।
স্টাকো ওয়াল
পরিচ্ছন্ন এবং দৃঢ় সাদা স্টাকোর পুরু দেয়াল, যা উষ্ণ লাল টাইলের ছাদের সাথে মানিয়ে যায়। একে অন্যের পরিপূরক এবং স্বতন্ত্র্য, কেউ কাউকে ছাপিয়ে নয় বরং শ্রদ্ধায় একসাথে অবস্থান করে, আবদ-এর-রহমানের কর্দোবার সাম্যবাদের মত। স্টাকোর এই পুরু প্রলেপ অন্যান্য বিল্ডিং উপকরণগুলির আবরণস্বরূপ প্রাকৃতিক ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সুরক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। স্প্যানিশ স্টাকো ওয়াল প্রায়শই সাদা বা ক্রিম রঙের হয়ে থাকে।
উন্মুক্ত কাঠের বীম
মর্ডান আর্কিটেকচারে আজকাল আমরা খামারবাড়ি বা ফার্মহাউস স্টাইলে দৃশ্যমান উন্মুক্ত কাঠের বীম ব্যবহার করার প্রবণতা রাখি। কিন্ত আধুনিক ডিজাইনাররা এটি গ্রহণ করার অনেক আগে থেকেই স্প্যানিশ আর্কিটেকচারে এটি একটি মূল স্হাপত্যশৈলী হিসেবে বিবেচিত হতো।এক্সপোজড বা উন্মুক্ত কাঠের বীম স্প্যানিশ স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ। ঐতিহ্যবাহী স্প্যানিশ বাড়িগুলি অ্যাডোব বা মাডব্রিক থেকে তৈরি করা হত, যা টেকসই এবং অত্যন্ত ভারী। ছাদকে ধরে রাখার জন্য কাঠের বীম ব্যবহার করা হত। বীমগুলি প্রায়শই এই স্টাকো দেয়ালগুলিকে ছাড়িয়ে যেত এবং বাইরে থেকে দৃশ্যমান ছিল।
মর্ডান আর্কিটেক্চার বা আধুনিক দালানের প্রাকটিসে আলংকারিক উন্মুক্ত বীম, স্প্যনিশ ভাষায় “vigas” তৈরি করা হয়, যা কাঠের সহায়তার উন্মুক্ত প্রান্তগুলিকে প্রজেক্ট করে—মূল কাঠামোর বাইরে। আধুনিক স্থাপত্যে দৃষ্টিনান্দনিকতা এবং স্ট্রাকচারাল ইনটিগ্রিটি নির্মাণে এই এক্সপোজড বীম এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন।
বাহুল্যবর্জিত অলঙ্করণ
স্প্যানিশ স্টাইলের বাড়ি কখনই একঘেয়ে মনে হয় না। তার একটি অন্যতম কারণ এটি অন্য বাহুল্যসঙ্কুল ইউরোপীয় আর্কিটেকচার থেকে আলাদা। আর এই পার্থক্য সৃষ্টি করেছে ডেকোরেশন বা অলঙ্কারের সুনিয়ন্ত্রিত এবং পরিমিত ব্যবহার। স্প্যানিশ স্টাইলে যখন অলঙ্কার বা ডেকোরেটিভ এলিমেন্ট ব্যবহার করা হয়, আলংকারিক উপাদানগুলি সাধারণত আর্চ বা খিলান এবং ছোট জানালার কাছাকাছি থাকে। অথচ বহির্মুখী প্রাচীরগুলির বিস্তৃত অংশ থাকে নিরলঙ্কার।
আর্চ (খিলান) এবং বক্ররেখা
পরিবারবৎসল স্প্যানিশদের পারিবারিক প্রসারের সাথে সাথে অর্থাৎ পরিবার বড় হওয়ার সাথে সাথে আবাসস্থলের বিদ্যমান কাঠামোর সাথে আরেকটি অংশ যুক্ত করার প্রচলিত ধারা স্পেনীয় বাড়িগুলির প্রকৃতিকে নানাভবে নিয়ন্ত্রণ করেছে । পরিকল্পনা অনুযায়ী তাই বাড়িগুলোর নকশা আয়তাকার হলেও স্প্যানিশ স্থাপত্যে খিলান, তোরণ এবং বক্ররেখা নানাভাবে প্রাধান্য পেয়েছে। মসৃণ আর্চওয়ে বা প্রবেশদ্বার, অভ্যন্তরের উঠোনের আস্তরণের আর্কেডগুলি এবং সিলিন্ড্রিকাল বা নলাকার বেদীগুলি স্প্যানিশ আর্কিটেক্চারের চিরন্তন মাধুর্য ।
ঘরে ফেরার অনুভব
‘ঘরে ফেরার আকুলতা’—যে কোনও কাঠামোর মধ্যে পিনপয়েন্ট করার জন্য সবচেয়ে কঠিন যে কাজ, সেটিই স্প্যানিশ আর্কিটেকচারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আর অর্জন। এই অসাধ্য সাধনের নানাবিধ উপায়ের মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক এবং স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার: যেমন পোড়ামাটি, স্লেট এবং কাঠের ব্যবহার, যা আগেই উল্লেখ করেছি। স্প্যানিশ স্থাপত্যে প্রাকৃতিক দৃশ্যের সম্প্রসারণ, পারিপার্শ্বিকতার সাথে মিশে বা ব্লেন্ড হয়ে যাওয়া, একাত্ম হওয়ার জন্য ভবনগুলিকে একটার সাথে আরেকটাকে জুড়ে দেয়া ইত্যাদি তারই প্রয়াস। তাই ঘরগুলি আকারে গ্র্যান্ড হওয়ার পরেও একটি উষ্ণ, আরামদায়ক অনুভূতি ( comfort zone) কখনই চাপা পড়ে যায় না, বরং প্রতি মুহূর্তে যেন নুইয়ে স্বাগত জানায় আগমনী বার্তায়!
রোমান্টিকতা
উষ্ণতা, ভালবাসাবোধ, স্বাচ্ছন্দ্য, এবং রোমানিটিসিজম—স্প্যানিশ আর্কিটেকচারের শক্ত ভিত। আমরা যেন ইচ্ছা করেই হারিয়ে যেতে চাই সেই সমস্ত রোমান্টিক স্পেসে, ঝুলানো বারান্দায়, বর্ণময় ফুলের বাগানে, লতাগুল্মশোভিত পোর্চে, আঙিনা আর উঠোনের প্রবাহিত ফোয়ারা-ধারায়। রট আয়রনের ছোট ছোট ডিটেইলের ব্যবহার স্প্যানিশ স্থাপনায় অসাধারণ হয়ে ওঠে। রোমান্টিক ধাঁচের ঘোরানো সিঁড়ি বা বারান্দার রেলিং, উইন্ডো কভারিং বা বাহ্যিক সজ্জায়, মার্জিত লোহার কারুকাজ যে কোনো স্পেসকে করে তোলে আরও আবেদনঘন এবং মোহময়।
উপলভ্য আউটডোর স্পেসকে নিজের বাড়িতে বন্দী করার এক অভাবনীয় পদ্ধতি মন্টেরি স্টাইলে বাড়ির সামনের অংশ বা পোর্চজুড়ে একটি দ্বিতল বারান্দা যুক্ত করা। দ্বিতল বারান্দাগুলি বাড়ির ব্যবহারের জায়গা বাড়িয়ে তোলে। অন্য দিকে স্প্যানিশ বাড়ির অন্তঃস্থিত উঠোনগুলি প্রকৃতিকে ভিতরে আমন্ত্রণ জানায়, বাতাসকে শীতল করে, ফুলের সুরভি ছড়ায়, রোমান্টিকতায় আপ্লুত করে বাসিন্দাদের, মাতিয়ে তোলে পরিপার্শ্বকে।
আলোকিত অভ্যন্তর আর প্রশস্ত খোলা ল্যান্ডস্কেপকে সাপোর্ট করা স্প্যনিশ আর্কিটেকচারের পূর্বশর্ত। উপযুক্ত জলবায়ু ও আবহাওয়া তাই এক্ষেত্রে মূল ক্রীড়ানক। পরিবেশ, প্রকৃতি আর জলবায়ু যদি অনুকূলে থাকে, স্প্যানিশ স্থাপত্যশৈলী তার উষ্ণ নান্দনিকতায় সৃষ্টি করতে পারে সেই মায়াবী আবাসস্থল যা ঘরের পানে টানে, যেখানে প্রতিদিন ফিরে আসতে সাধ জাগে (to return to everyday), যেখানে বার বার ফিরে আসা যায়, বার বার ফিরে আসতে হয়।
—————————————————————————————-

লেখক-পরিচিতি:: লায়লা ফারজানা পেশায় স্থপতি। পাশাপাশি তিনি একজন সংগীতশিল্পী, নাট্যশিল্পী, কবি ও চিত্রশিল্পী। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক, ইউনিভার্সিটি অফ টরেন্টো থেকে আরবান ডিজাইন-এ এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়—নিউ ইয়র্ক থেকে আরবান ডিজাইন ও স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতকোত্তর করেছেন। তিনি নিউইয়র্ক সিটি স্কুল কনস্ট্রাকসন অথোরিটিতে স্থপতি হিসাবে কাজ করছেন। এর বাইরেও লায়লা ফারজানা ডিস্টুডিওডি আর্কিটেক্টস এবং ইঞ্জিনিয়ার্স (দ্য স্টুডিও অফ ডিজাইন)-এর প্রধান।