নোবেল বিজয়ী লুইস গ্লাক’র জন্ম ১৯৪৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে। কিন্তু বেড়ে ওঠেন নিউ ইয়র্কের লং আইল্যান্ডে। তিনি ১৯৬১ সালে জর্জ ডব্লিউ হাই স্কুল, হিউলেট, নিউ ইয়র্ক থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। পরবর্তীতে তিনি সারাহ লরেন্সে কলেজ ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। বর্তমানে তিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। লুইস গ্লাক তাঁর ‘ওয়াইল্ড আইরিস’ কবিতা-গ্রন্থের জন্য ১৯৯৩ সালে পুলিৎজার প্রাইজ পান। তিনি পুলিৎজার প্রাইজ’র পাশাপাশি ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল অ্যাওয়ার্ড, দ্য একাডেমি অব অ্যামেরিকান পোয়েট’স প্রাইজসহ বেশ কিছু পুরস্কারে ভূষিত হন। অবশেষ ২০২০ সালে সাহিত্য নোবেল পুরস্কার পান তিনি। নোবেল-কমিটি তাদের বক্তব্যে বলেন, ‘”Her unmistakable poetic voice that with austere beauty makes individual existence universal”। লুইস গ্লাকের কবিতা মূলত আত্মজৈবনিক। ব্যক্তিগত হতাশা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সাফল্য-ব্যর্থতা, নিঃসঙ্গতা ধ্রুপদী মিথের সাথে মাখামাখি হয়ে ধরা দিয়েছে তাঁর কবিতায়। লুইস গ্লাকের কবিতার বইয়ের সংখ্যা মোট এগারটি। তন্মধ্যে ’দ্য সেভেন এইজ’ , ’ভিটা নোভা’ ও ‘এভেরনো’ উল্লেখযোগ্য। কবিতার পাশাপাশি ‘প্রুফস এন্ড থিওরিস’, ‘এসেস অন পোয়েট্রি’ তাঁর বহুল আলোচিত গদ্যসংগ্রহ।
ভালবাসার পুরাকথা (A Myth of Devotion) হেডিস যখন সিদ্ধান্ত নিল সে মেয়েটিকে ভালোবাসে— সে তার জন্য একটি নকল পৃথিবী তৈরি করল, পাতালের তৃণভূমিতে, সব কিছুই এক, কিন্তু যুক্ত হল একটি বিছানা। সব কিছুই এক, এমনকি সূর্যের আলোও, কারণ, একটি কিশোরী মেয়ের জন্য হঠাৎ উজ্জ্বল আলো থেকে একেবারে অন্ধকারে যাওয়া কঠিন। ভাবল, ক্রমান্বয়ে সে রাত নিয়ে আসবে। প্রথমে ঝড়ো পাতার ছায়ার মতো। তারপর চাঁদ। তারপর তারা। তারপর না চাঁদ, না তারা। যাতে পার্সফোন ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয় পাতালে । সে ভেবেছিল,নকল পৃথিবীতে শেষ পর্যন্ত হয়ত পার্সফোন সুখেই থাকবে, কারণ, এই নকল পৃথিবীতে আছে পৃথিবীর সব কিছু কিন্তু আছে ভালবাসা। সবাই কি ভালোবাসা চায় না? অনেক বছর অপেক্ষা করে তিল তিল করে সে গড়ে তোলে সেই জগত তার চোখের সামনে বেড়ে ওঠে পার্সফোন পাতালের ঘাসে ঘাসে। পাতালের ঘাসে ঘাসে বেড়ে ওঠে পার্সেফোন। কখনও গন্ধে মাতোয়ারা। কখনও স্বাদে আত্মহারা। তারপর সে ভাবল শুধুমাত্র একটি স্বাদের কথা, একটি ক্ষুধা। যে স্বাদের উপরে নেই কোনো স্বাদ; যে ক্ষুধা যদি থাকে তবে সে ভেবেছিল,সব আছে। রাতের গভীরে সবাই কি চায় না প্রিয় শরীরের স্পর্শ, বেষ্টিত বাহুর দখল? শুনতে কি চায় না নিঃশ্বাসের সেই কথা: আমি আছি তাই তুমি আছ, আমাকে শুনতে পাও বলেই তুমি এখানে, আমার পাশে! যখন একজন পাশ ফিরে—আরেকজনও ঘুরে যায়— গড়ে তোলা পার্সেফোনের জগতের দিকে দৃষ্টি মেলে যখন তাই ভাবছিল যমপুরীর অধিপতি, সে উপলব্ধি করেনি—যেখানে ঘ্রাণ নেই সেখানে ক্ষুধা অসম্ভব। অপরাধবোধ? সন্ত্রাস? ভালোবাসার ভয়? বিষয়গুলো কল্পনা করেনি সে; কোনো প্রেমিকই কখনো তাদের কল্পনা করে না। সে স্বপ্ন দেখতে থাকে, সে ভাবতে থাকে— জগতটিকে কী নামে ডাকা যায়— প্রথমে ভাবল:নতুন নরক । তারপর: বাগান । শেষ পর্যন্ত : পার্সিফোনের মেয়েবেলা । একটি নরম আলোর স্তর ঘাসের উপরে উঠছে, বিছানার পিছনে। সে তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। বলতে চায়— কোনো কষ্ট স্পর্শ করতে পারবে না তোমাকে। কারণ আমি তোমাকে ভালবাসি। পরমুহূর্তেই অনুভব করে কতটা মিথ্যা এই শপথ! তাই অবশেষে বলে— কোনো কষ্ট স্পর্শ করতে পারবে না তোমাকে। কারণ তুমি মৃত। সত্যটা তাঁর জানা হয়ে গিয়েছিল ভালবাসাই কষ্ট দেয় মৃত্যু নয়। অ্যাকিলিসের জয় (The Triumph Of Achilles) প্যাট্রোক্লাসের গল্পে কেউ বাঁচেনি, এমনকি অ্যাকিলিসও যিনি অর্ধেক দেবতা, অর্ধেক মানুষ—প্রায় ঈশ্বর, আর প্যাট্রোক্লাস তার একাত্মা—প্রতিচ্ছায়া—অনুরূপ। একই বর্ম পরতেন দুজনে। তবুও সে বন্ধুত্বে একজন আরেকজনের অনুগত, একজন আরেকজনের চেয়ে কম: সর্বদা দৃশ্যমান সে অনুক্রম। কিংবদন্তি সত্য নয় কিন্তু— জীবন্ত— পরিত্যক্ত কিন্তু জাগ্রত। এ ক্ষতির তুলনায় কি তুচ্ছ নয় আগুনে জ্বলে যাওয়া গ্রিক জাহাজগুলো? তাঁবুতে, অ্যাকিলিসের পুরো সত্ত্বা শোকে মুহ্য— আর দেবতারা দেখছিল একটি মৃত মানুষ, ইতিমধ্যেই যে মরে গেছে, প্রেমের শিকার হয়ে যার দেবত্ব আত্মসমর্পণ করেছে তাঁর মনুষ্যত্বের কাছে, অর্ধেক দেবতা আজ সম্পূর্ণ মানুষ— যে মানুষ প্রেমিক, যে মানুষ মরণশীল। ভিটা নোভা (Vita Nova) তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ, তোমারই আমাকে মনে রাখা উচিত। এ বছরের বসন্তকাল; ফেরি বোটের টিকিট কিনছে যুবকরা। বাতাসে হাসি; কারণ আপেলের মঞ্জরিতে বাতাস পূর্ণ। জেগে উঠে অনুভব করলাম একদিন আমারও সেই দিন ছিল, সেই শৈশব, সেই শব্দ, সেই বিনা কারণে হাসি, শুধুমাত্র পৃথিবী এত সুন্দর বলেই বোধ হয়। লুগানো। আপেল গাছের নিচে টেবিল। ডেকহ্যান্ডগুলির রঙিন পতাকা উত্তোলন ও নামানো। এবং হ্রদের প্রান্তে, এক যুবকের তার টুপি পানিতে ছুঁড়ে ফেলা; হয়তো প্রেমিকা দিয়েছে সম্মতি। সেই গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি— যেন বৃহত্তর থিমের শুরুতে একটি ভূমিকা— আর তারপর অব্যবহৃত, কবর। দূরের দ্বীপে,আমার মায়ের হাতে ছোট্ট কেকের প্লেট— যতদূর মনে পড়ে,সেই অবিকল— বদলায়নি একটুও, উজ্জ্বল আর অক্ষত সেই মুহূর্ত— রোদে ঝলসে যায়নি একটুও, তাই আমি জেগে উঠেছি, সুখে, এ বয়সেও জীবনের প্রতি ক্ষুধা আর পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে— টেবিলের পাশে নতুন ঘাসের ফালি, ফ্যাকাশে সবুজের টুকরা হয়ে গাঢ় মাটির রঙে মিশে যায়। আমি নিশ্চিত বসন্ত আবার ফিরে এসেছে আমার কাছে, এবার প্রেমিক হয়ে নয়, মৃত্যুর বার্তাবাহক হয়ে, তবুও যে বসন্ত তাই বুঝি কোমল। ইচ্ছাটি (The Wish) মনে আছে সেই সময়টা? যখন তুমি কিছু ইচ্ছা করেছিলে? আমারও অনেক কিছু চাওয়ার আছে। সেই সময় আমি তোমাকে যে প্রজাপতিটার কথা বলেছিলাম সেটা মিথ্যা ছিল। আমি সব সময় ভাবতাম তুমি কী চাও? তুমি কী চেয়েছিলে সেদিন? তুমি কী মনে করো? আমি কী চেয়েছিলাম? আমি জানি না। যে আমি ফিরে আসব কিনা, যে আমরা শেষ পর্যন্ত একসাথে থাকব কিনা। আমি তাই চাই—যা সব সময় চেয়েছি । আমি চেয়েছিলাম অন্য একটি কবিতা। রূপালি পদ্ম (The Silver Lily) আবারও রাতগুলো শীতল, প্রথম বসন্তের রাতের মতো, আবারও শান্ত। কথা বললে কি বিরক্ত হবে? আমরা এখন একা; আমাদের চুপ থাকার কোনো কারণ নেই। তুমি কি দেখতে পাচ্ছ, বাগানে পূর্ণিমার চাঁদ। পরের পূর্ণিমা আমার আর দেখা হবে না। বসন্তে, যখন চাঁদ উঠেছিল, তখন সময় ছিল অফুরন্ত। সাদা জলপ্রপাতের মতো ঝরছিল তুষারের ফুলকুঁড়ি আর মেপলবীজের গুচ্ছ। সাদার ওপর সাদা, বার্চ গাছের উপরে সাদা চাঁদ। আর সে বৃত্তাকার চক্রে, যেখানে গাছটি, চাঁদের নরম সবুজ-রূপালি আলোয়, খণ্ডিত ছিল প্রথম ড্যাফোডিলের পাতা। অনেক দূরে চলে এসেছি আমরা একসাথে— জীবনের একদম শেষ প্রান্তে—শেষের ভয় করেছে গ্রাস। এমনকি এই রাতগুলিতে, আমি এখনও নিশ্চিত নই সমাপ্তির অর্থ কী। আর তুমি, যে ছিলে একজন পুরুষের সাথে— প্রথম কান্নার পর, আনন্দও কি ভয়ের মতো নিশ্চুপ হয়ে যায় না? সান্ধ্যকালীন প্রার্থনাগুলো (Vespers) তোমার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে, তুমি আমাকে দিয়েছ পৃথিবীকে ব্যবহারের অনুমতি, প্রত্যাশিত বিনিয়োগে কিছু রিটার্ন। অবশ্যই আমাকে বিবৃত করতে হবে আমার ব্যর্থতা, মুখ্যত টমেটো গাছগুলো সম্পর্কে। আমি মনে করি আমাকে টমেটো-চাষাবাদে উৎসাহিত করা উচিত নয়। আর যদিওবা করি, তোমাকে প্রতিরোধ করতে হবে প্রবল বৃষ্টি, শীতল রাত—যা এখানে প্রচলিত—প্রায়ই আসে অন্য অঞ্চলে যখন গ্রীষ্মের বারো সপ্তাহ। এই সবই তোমার; অথচ: বীজ রোপণ করেছি আমি, মাটি ছিঁড়ে ডানা মেলার মত প্রথম অঙ্কুর দেখেছি আমি, এবং ওটা ছিল আমার হৃদয়—ব্লাইটের আঘাতে ভাঙা, গুণিতক হারে বাড়ছিল কালো দাগগুলি—কাতারে কাতারে। আমি জানি, সে বোধকে বোঝার মতো হৃদয় তোমার নেই। আমি জানি, তোমার মতো যারা— মৃত আর জীবিতের মধ্যে কোনো তফাৎ করো না— পূর্বাভাসে তারা দায়মুক্ত, নিরাপদ। অথচ; তুমিই জানো না কতটা ত্রাস আমরা বুক পেতে নিই, কতটা সন্ত্রাস সহ্য করি, কতটা আতঙ্কিত হই পাতায় একটি সামান্য ক্ষতে, এমনকি হেমন্তের প্রথম অন্ধকারে; যখন মেপলের লাল পাতা ঝরে; আমি দায়বদ্ধ— সেই ঝরা লতাগুলোর কাছে। বুনো আইরিস (The Wild Iris) আমার তীব্র কষ্টের শেষে ছিল একটি খোলা দরজা। আমার কথা শুনুন: আমি মনে করি সেটিই ছিল যাকে আপনারা বলেন—মৃত্যু। ঊর্ধাকাশে,আওয়াজ,স্থানান্তরিত পাইনের শাখা। তারপরে কেবল শূন্যতা। খরখরে ভূ-পৃষ্ঠে দুর্বল সূর্যের ঝাপসা আলোর আভা। তাই ভয়াবহ এই বেঁচে থাকা অন্ধকার পৃথিবীতে সমাহিত যখন চেতনা । তারপরে সমাপ্তি : যা আপনাদের ভয়, একটি আত্মা এবং অক্ষম কথা বলার চেষ্টা, হঠাৎ ফুরিয়ে যাওয়া, দুর্ভেদ্য পৃথিবীর একটু শিথিলতা । আর আমি হতে চেয়েছি বুনোলতার নিচু ঝোপে তীরবিদ্ধ পাখিদের মতো। আমি বলছি, আপনারা ভুলে গেছেন সেই পথ, ছিন্ন করেছেন এই পৃথিবীর সাথে সেই পৃথিবীর যোগাযোগ। তবুও আমি আবারও বলতে চাই: বিস্মৃতি থেকে ফিরে আসা একটি কণ্ঠ, একটি আওয়াজকে খুঁজে পেতে: আমার জীবনের কেন্দ্র থেকে উৎসারিত একটি অদম্য ঝর্ণা, গভীর নীল সমুদ্রে গভীর নীল ছায়া।
কবি লায়লা ফারজানা পেশায় স্থপতি। পাশাপাশি তিনি একজন সংগীতশিল্পী, নাট্যশিল্পী ও চিত্রশিল্পী। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক, ইউনিভার্সিটি অফ টরেন্টো থেকে আরবান ডিজাইন-এ এবং নিউ ইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরবান ডিজাইন ও স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতকোত্তর করেছেন। তিনি নিউ ইয়র্ক সিটি স্কুল কনস্ট্রাকশন অথোরিটিতে স্থপতি হিসাবে কাজ করছেন। এর বাইরেও লায়লা ফারজানা ডিস্টুডিওডি আর্কিটেক্টস এবং ইঞ্জিনিয়ার্স (দ্য স্টুডিও অফ ডিজাইন)-এর প্রধান।