পাঠক হিসাবে আমি প্রথম মাসুদ খানে প্রবেশ করেছিলাম তাঁর নদীকূল-যাপনের সময়— দ্বিতীয় গ্রন্থ নদীকূলে করি বাস-এ। আমার জন্য এ গ্রন্থ ছিল এক আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। যে ধরনের কবিতার জন্য হা-পিত্যেশ করে থাকি আমি, তেমন কিছু রচনা এই বইয়ে জড়ো করে এ কবি আমার কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণের স্ব-ছন্দে— স্বাচ্ছন্দ্যে— কবিতাগুলো উপভোগ করা গেছে। উপভোগযোগ্যতার প্রধান কারণটি এখানে জানিয়ে রাখতে চাই। তাঁর কবিতার পঙক্তি ও স্তবকগুলো পাঠক হিসাবে আমাকে যথেষ্ট পাত্তা দিয়েছে। তিষ্ঠাবার, ভাববার, ভোগ করবার অবকাশ দিয়েছে। যেসব শব্দ আর অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন তিনি, তা সাধারণভাবে আমার অপরিচিত নয়। কিন্তু পরিচয়ের গভীর গন্ডির ভিতরেই অপরিচয়ের কুহকী ছায়া নির্মিত হওয়ায় চমৎকৃত হতে হতে লক্ষ করি : কবির বিশেষ তাড়া নাই। সমগ্র কবিতার যে অংশটিতে এইমাত্র প্রবেশ করা গেছে, আর প্রবেশমুখেই কুশলতার নানা কারিগরিতে জন্ম নেয়া বিবশতা ভোগ করবার জন্য ক্ষণকাল তিষ্ঠাবার একটা আকাঙ্ক্ষা যখন মনের মধ্যে তৈরি হয়েছে, তখন দেখি কবি নিজেও ভোগ করছেন অনুষঙ্গটি। পুনরাবৃত্তি ও অন্যবিধ কৌশলে ঐ অবকাশটি তৈরি হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায়। আর এর মধ্যেই পেয়ে যাচ্ছি পরবর্তী অংশে প্রবেশ বক্তব্যের বিস্তার আর পুনরাবৃত্তি কবির জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ; যতই তা ব্যক্তিত্বচিহ্নিত হোক না কেন।
ঝুঁকিপূর্ণ এ অর্থে, আড়াল তৈরি করার যে শৈল্পিক দায় আমরা স্রষ্টার কাছে প্রতিনিয়ত প্রত্যাশা করি, এতে করে তাতে ঘাটতি দ্যাখা দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কী কৌশলে মাসুদ খান এ দায় সহিসালামতে সামলে নেন, তার দু-চার প্রস্ত ফিরিস্তি পরে দেয়া যাবে। আপাতত বলতে চাই, প্রথম গ্রন্থের দুর্বোধ্যতা এবং শব্দ ও পঙক্তি বিন্যাসের উল্লম্ফন সত্ত্বেও তাঁর কবিতার উক্ত বৈশিষ্ট্য আমাদের নজর এড়ায় না। অবশ্য প্রথম গ্রন্থের তুলনায় দ্বিতীয় গ্রন্থে আর দ্বিতীয়টির সাপেক্ষে তৃতীয়টিতে তাঁর বিবর্তন-পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। কব্জিতে বেশ শক্তি ধরেন মাসুদ খান। তাঁর প্রথম গ্রন্থের প্রথম কবিতাটি এই কবিতাগুচ্ছের সাথে অনেকটাই বেমানান। বেশ কিছুদূর বিজ্ঞান, মহাকাল আর অকাব্যোচিত বস্তুজগৎ নিয়ে গড়া মাসুদ খানের কাব্যভুবনের প্রথমভাগে সহসা যেন এক টুকরা মরূদ্যানের মতো আবির্ভূত হয় ‘কুড়িগ্রাম’। এ নশ্বর পৃথিবীতে কত কিছুই তো না পেয়ে ছাড়তে হবে ধরাধাম। আর কল্পনাদেবীর বরাতে এ নিয়ে কবিদের কী বিপুল অনুযোগ-বিযোগ! মাসুদ খান পেতে চাননি, চেয়েছেন যেতে। কিংবা হয়ত যেতেও নয়; ‘কোনোদিন আমি যাইনি কুড়িগ্রাম’, ‘কোনোদিন যাওয়া হবে না কুড়িগ্রাম’— এই দুই কালজ্ঞাপক পঙক্তির মধ্যবর্তী অচিন দেশটি তো গমনাতীত অভিজ্ঞতারই স্মারক। বেশ দুটো মাছরাঙা আর পানকৌড়ি আর প্রাচীর-ডিঙানো মানুষ আর ভুলোমনা বাবুই নিয়ে করুণ-কোমল এক কুড়িগ্রাম রচেছেন কবি। পড়তে পড়তে উপরের দিকে চোখ রেখে খুঁজতে ইচ্ছা হয় ‘আকাশের মুখে তিল’, আর একটা মন খারাপ করা দীর্ঘশ্বাস ভিতর থেকে উঠে আসে এসব তুচ্ছ উপকরণের তুচ্ছতাকে একটুও আমলে না এনে। ‘কুড়িগ্রাম’-এ মাসুদ খান সহজ কবিত্বের এক উপভোগ্য স্মারক তৈরি করতে পেরেছেন।
এরপর এ গ্রন্থে আমরা প্রবেশ করি এক জটিল-অভাবনীয়-মনোহারী কবিতাবিশ্বে— যে বিশ্ব নিজের স্বাতন্ত্র্যের ব্যাপারে এককণা ছাড় না দিয়েও দেখিয়ে যায় আপন কুশলতার মহিমা।
শুরু থেকেই স্থান ও কালের এক বিপুল বিস্তার ধরেন এই কবি। জীবনানন্দের চেয়েও বিপুল আর অন্তর্গত যুক্তিশৃঙ্খলা ও বিজ্ঞানসম্মত ভঙ্গির ছত্রছায়ায় বেশ অনুভূতিগ্রাহ্য আর ইন্দ্রিয়গোচর। মনে হয় নিজেকে চিহ্নিত করার জন্য মহাজগতের বিশাল ক্যানভাসে সাহসী এক যুবক প্রকৃতিবিজ্ঞানের অনন্ত সূত্র আর নির্বাচিত-যুৎসই প্রযুক্তি নিয়ে জরিপ চালাচ্ছে। প্রথম দিকের কবিতায় মানুষের তুলনায় জড়জগতের প্রতি তাঁর আকর্ষণের একটা বৈধতা এই জরিপকারী যুবকের প্রয়োজনের সাথে বেশ খাপ খেয়ে যায়। গতিশীল প্রাণীকুল আর উদ্ভিদজগতের মধ্যেও জড়ের কোষ-আভ্যন্তরীণ লীলা প্রত্যক্ষ করেন তিনি; আর জড়ের অভ্যন্তরে গতির চাঞ্চল্য। বিবর্তন সেখানে বর্তমানের গায়ে কিছুটা অভ্যন্তরে জেগে থাকা সূত্রের মতো প্রত্যক্ষ; ক্ষুদ্র ও বিশালের পার্থক্য অভ্যন্তর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার অপ্রকাশ্য চাপল্যে দূরীভূত। প্রথম দিকের কবিতার এ বিপুল বিস্তার পরেও অক্ষুণ্ন থেকেছে অনেককাল। কিন্তু নিষ্প্রাণ বস্তুর স্থান সেখানে দখল করেছে প্রাণবান চলাচল, আর তত্ত্ববাহী অনুষঙ্গের বদলে জীবনের সারাৎসার।
বিচিত্র রঙের-বর্ণের-আলোর উদ্ভাস মাসুদ খানের কবিতার নানা প্রান্তকে বেশ অনেকটা রঙিলা করে রেখেছে। হয়ত বা এ কেবল আলোরই খেলা— জ্ঞানসূত্রে আমরা যেমন জানি, তেমনি জানেন মাসুদ খানও : রং তো আলোরই বিচিত্র কারসাজি, নানা ক্রীড়ার কায়কসরত। এ ‘জ্ঞান’ লুকানোর চেষ্টা পাখিতীর্থদিনে বইতে একেবারেই নাই; পরের দিকেও এর তেজ কমেছে, কিন্তু প্রতাপ লুপ্ত হয়নি। কী লোভাতুর পিপাসায় যে দ্রষ্টব্যে আলোর সন্ধান করেছেন এ কবি! ‘ত্রিজ’ কবিতায় দেখি পুনর্ভবা নদীর মধ্যভাগ আর চারপাশটাকে ‘তুখোড় তরুণ আলোকের অধ্যাপনা’য় পুরোপুরি সয়লাব করে দিয়ে কবি অবিমৃষ্যকারী মাতালের মতো সর্বাঙ্গে মাখছেন সেই অপরূপ রূপ। মাসুদ খান প্রায়শই বিশেষ দৃশ্য বা অনুষঙ্গের অপার বিস্তার সাধন করেন, আর এক ফাঁকে নিজেকে বিস্তৃত করে দেন স্থান ও কালের নিরবধি অবধি। ‘ত্রিজ’ কবিতায়ও করেছেন তাই। সে প্রসঙ্গে আমরা পরে একবার আসব। আপাতত বলা যাক, সংবিৎহারা কৈ-এর মতো কানকোয় ভর দিয়ে ডাঙায় উঠে এসেছেন তিনি যে লোভে, সেই লোভে পড়ার মতো সৌন্দর্য-সৌকর্য তিনি পুনর্ভবার জল থেকে ছেনে তুলতে পেরেছেন। এ প্রসঙ্গে ‘তূর্ণট্রেনে আলোকবধূর পিত্রালয়ে যাওয়া’ কবিতারও উল্লেখ করতে পারি, যেখানে ‘নদীগুলো বহুস্তর কাচের প্রবাহ— ঠিক্রে পড়ছে / চুয়ান্নতল হীরকের রেশমরশ্মিপ্রভা’; কিংবা চলে যেতে পারি ‘সাবস্টেশনে একা একজন লোক’ কবিতায়, যেখানে ‘সাবস্টেশনের আলো / তরুণ প্রফেটের মতো জ্বলে’। এরকম আরো বহু কবিতায় দেখি, মাসুদ খান শুধু দৃশ্যের প্ররোচনায় বস্তুজগতে অবগাহন করেছেন। সেই দৃশ্য অবশ্য যথাপ্রাপ্ত দৃশ্য নয়; অর্থাৎ এমন নয় যে, বিদ্যমান দৃশ্যমানতার অপরিসীম বৈভব বা মোহনীয় হাতছানি তাঁর দ্যাখার তৃপ্তি যুগিয়েছে। বরং এ হল বিদ্যমান সংস্থানকে ভিতর থেকে বদলে দিয়ে তৈরি করা এক নতুন জ্যোতি। এক্ষেত্রে আবশ্যিক সহচরের মতো জায়মান থেকেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ‘জ্ঞান’। বলা যাক, পরিবর্তক-বিবর্ধক চশমার প্রযত্নে দ্যাখা এ এক বর্ণিল পৃথিবী। দ্যাখার এ আগ্রহ— ভিতর থেকে নিজের মতো করে দ্যাখার— মাসুদ খানের কবিতায় শেষ পর্যন্ত সক্রিয় থেকেছে; তবে দ্বিতীয়-তৃতীয় গ্রন্থে রূপরেখায় তা এতদূর বদলেছে যে, একে নতুন ব্যাপার বলেই মনে হয়। আমরা পরে দেখব, দৃষ্টিইন্দ্রিয়ের সহগামী হয়ে অন্য ইন্দ্রিয়— বিশেষত কান— যুক্ত হওয়া একটা বড় রূপান্তর। তাছাড়া, পরের দিকে প্রধানত তাঁর ভাবুকসত্তাটি গুরুতর হয়ে ওঠায় এবং বস্তুজগতের তুলনায় মানুষের আনাগোনা ব্যাপক হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে দ্রষ্টব্যেরও বদল ঘটেছে। আগে বস্তুজগতের অনুষঙ্গ-সংগঠন-সংঘটনকে যুৎসই পছন্দনীয় ভাষায়— সম্ভবত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি থেকে আহরিত ভাষায়— হাজির করে লক্ষ্য হাসিলের আস্বাদ পেতেন তিনি। পরে সে আস্বাদ নিয়েছে সহযোগীর ভূমিকা, মুখ্য হয়ে উঠেছে দ্রষ্টার বিবেচনা। উদাহরণযোগে কথাটা পরীক্ষা করা যাক।
‘একটি চিত্রিত হরিণের পেছনে একটি চিত্রিত বাঘ ছুটছে’ নামে পাখিতীর্থদিনে কাব্যে একটা কবিতা আছে। শিরোনামটি দীর্ঘ; আর এই দৈর্ঘ্যেই কবিতাটির সমাপ্তি। এরপর বিচিত্র বর্ণযোজনায় শিরোনামের ছবিটিকেই বিশেষায়িত করে যান কবি— ভোগ করেন আর ভোগের জন্য হাজির করেন। কোনো কোনো ছবি যেমন বিভিন্ন দিক থেকে দেখলে ধারণ করে ভিন্ন ভিন্ন মুরতি, অনেকটা তেমন কুশলতার আশ্বাসে সুস্বাদু হয়ে ওঠে ছবিটি। এরকম রচনা তাঁর প্রথম বইতে বিস্তর, দ্বিতীয়টিতেও কম নেই। বৈশিষ্ট্যের রূপ-গুণ খানিক বাড়িয়ে-কমিয়ে এ তালিকায় নিয়ে নিতে পারি প্রথম গ্রন্থের ‘ধূলিবিদ্যা’, ‘প্রজাপতি’, ‘স্রোত’ কবিতার কয়েকখণ্ড, ‘ক্লাউন’, ‘সিমেন্ট/আর.সি.সি.’,‘পরমাণু’,‘কবরের উপকথা’ ইত্যাদি অনেক কটি রচনা। এসব কবিতা অবশ্য একবাক্যে চিহ্নিত হওয়ার মতো সমরূপ নয়। যেমন, ‘পরমাণু’ শিরোনামের পঙক্তিগুলো বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টি আর বড়– চন্ডীদাসের সৃষ্টির যৌথ আবেগে পাঠককে বেশ এক পাক ঘুরিয়ে আনার শক্তি ধরে। ‘সিমেন্ট/আর.সি.সি.‘ কবিতার ইতিপূর্বে না দ্যাখা নাট্যাংশগুলো দেখে ফেলার পর চিম্বুক পাহাড় আর আগের মতো থাকে না। কল্পনার উত্তুঙ্গ বিভা বিশিষ্ট চিত্রকল্পের বেশে একত্রিত হয়ে কবিতাগুলোকে পরিয়ে দেয় নানা রঙের আলো। কিন্তু মোটের উপর একথা বোধ হয় বলা যাবে যে, শেষ পর্যন্ত দ্রষ্টব্যেই এগুলো অবসান মেনেছে— অন্যতর বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা ধরেনি। ভিন্ন মেজাজের কিছু চমৎকার কবিতা থাকা সত্ত্বেও এই ভঙ্গিটিই পাখিতীর্থদিনে কাব্যের কবিতারাজ্যে সপ্রতাপ অধিষ্ঠান পেয়েছে।
কিন্তু দ্বিতীয় গ্রন্থ নদীকূলে করি বাস প্রসঙ্গে এরকম বলা যাবে না। পূর্বোক্ত বৈশিষ্ট্য এ গ্রন্থেও বিরল নয়, কিন্তু প্রতাপের দিক থেকে বেশ কতদূর রাজ্যহারা— সাফল্যের এলাকায় তো বটেই। ‘বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা’ শিরোনামের পঙক্তিগুলোকে হাজির করা যাক সাক্ষী হিসাবে। দ্রষ্টব্য আকারে এখানে মেঘ উপস্থিত; দ্বিতীয়বার একইরূপে হাজির না হওয়ার রহস্য নিয়ে বিজলি অস্তিত্ববান। আর এসব বিজ্ঞানগন্ধী বিষয়-আশয়কে যুৎসই ভাষা দিতে হাজির আছে জ্যামিতির সৈন্যসামন্ত-জ্ঞান। কিন্তু এসবে কবিতাটির ইতি নয়— আদি মাত্র। সেই আদিকাণ্ড বয়ে নিয়ে যায় এক ‘আমি’ :
এইরূপে খেলা করো, লুকোচুরি আমার সহিত
আমি থাকি সুদূর রূপতরঙ্গ গাঁয়, আর তোমার সহিত
তোমারই সাহিত্যে আহা এভাবে আমার বেলা বয়ে যায়।
আমাদের পূর্বোক্ত কবিতাগুলোতে দ্রষ্টব্যের এরূপ প্রসার বেশ খানিকটা অনুপস্থিত থেকেছে। সেই বিয়োগে কবিতার ক্ষতি হয়েছে কি না সে সিদ্ধান্ত তর্কসাপেক্ষ; কিন্তু যোগে যে যথেষ্ট উপকার হয়েছে তা জোর দিয়ে বলা যায়। এর দৌলতেই রোমান্টিক কল্পনা, রহস্য আর মনন এখানে— এই কবিতায়— কবিতার ইতিহাসের মধ্যে থেকেই প্রায় সম্পূর্ণ নতুন এক রূপকল্পে অভিষিক্ত হতে পেরেছে। তৈরি হয়েছে ‘জন্ম এক রুদ্ধভাষ জাতিতে আমার’-এর মতো বহুস্তর পঙক্তি।
এ কবিতার সম্পূর্ণতাও বেশ উপভোগ্য। মাসুদ খান পছন্দ করেন সম্পূর্ণ রূপকল্প— প্রথম পঙক্তি তাঁর কাছে যথার্থই শুরু, আর শেষ পঙক্তি সমাপ্তিরেখা নির্দেশক। আবদুল মান্নান সৈয়দ একবার আল মাহমুদ সম্পর্কে লিখেছিলেন— আমাদের মধ্যে আল মাহমুদের কবিতা সবচেয়ে সম্পূর্ণ। কথাটা হুবহু চালানো যায় মাসুদ খানের নামে। রূপকল্পের সম্পূর্ণতার প্রতি এতটা মনোযোগী কবি আমাদের কবিকুলে বিরল। প্রথম থেকে দুর্বোধ্য ও বিশিষ্ট চিত্রকল্পের পাশাপাশি সম্পূর্ণতার কসরতও তাঁর কবিতায় লক্ষ করবার মতো। দ্বিতীয় গ্রন্থে এ সাফল্য যথার্থ সিদ্ধি পেয়েছে, আর তৃতীয় গ্রন্থ অবধি তা অব্যাহত থেকেছে।
খুব সম্ভব কবিতার শারীরী সংস্থানের প্রতি তীব্র মনোযোগের পাশাপাশি ‘কিছু’ বলবার দায়বোধ এ বিশিষ্টতার উৎস। মাসুদ খান কিছু বলতে চান, পাঠককে নিয়ে যেতে চান উপসংহারে। প্রথম গ্রন্থে তাঁর এ আকাঙ্ক্ষা বিশেষ উচ্চকিত নয়; তবুও দ্রুত বেছে নিতে পারি ‘কুড়িগ্রাম’, ‘ত্রিজ’, ‘সিমেন্ট/আর.সি.সি.’, ‘পরমাণু’, ‘সার্কারামা’ ইত্যাদি শিরোনাম, যেখানে পরিকল্পিত রূপকল্পের আদি ও অন্ত ঠিকঠাক চিনে নেয়া যায়। দ্বিতীয় গ্রন্থে এ হার বেড়েছে, তৃতীয়টিতে আরো বেশি।
আগেই বলেছি স্থান ও কালের বিপুল বিস্তার ধরেন এই কবি। আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তাবত জীব ও জড় উপাদানকে দেখতে পান বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় বিকাশ-উন্মুখ। ডারউইনীয় বিবর্তনবাদ বা সৃষ্টিতত্ত্ব তাঁর এই দৃষ্টিতে কতটা ক্রিয়াশীল থেকেছে বলা মুশকিল। কিন্তু বৃহত্তর কোনো পরিপ্রেক্ষিতের সাথে ব্যক্তি ও বস্তুকে মিলিয়ে নেয়ার একটা প্রেরণা তাঁর অনেকগুলো কবিতাকে মহার্ঘ করেছে। ‘ত্রিজ’ কবিতায় কবি উৎসবের আমেজে উদযাপন করেছেন সৃষ্টির ঊষালগ্ন অবধি। ‘সার্কারামা’য় মাত্রাবৃত্তের নৃত্যচঞ্চল কিন্তু সংযত বিভায় আর অসংলগ্ন চিত্রকল্প ও অনুষঙ্গের চমকে ভোগ করা গেছে বিবর্তনের নানা সৃষ্টিশীল পর্যায়। এ কবিতার শেষ সিদ্ধান্ত-পঙক্তি দুটি তো অবিস্মরণ :
শ্রবণ বধির করে দিয়ে বয় মহাবৃত্তের হাওয়া
বস্তুর থেকে বিকশিত ফের বস্তুতে ফিরে যাওয়া।
প্রথম গ্রন্থেই মাসুদ খান আয় করে নিয়েছেন নিজের কাব্যমুদ্রা; কয়েকটি চমৎকার কবিতা জমেছে ভাঁড়ারে; আরো আছে অভাবিত চিত্রকল্পের জবরদস্ত এক সংগ্রহ। তা সত্ত্বেও পাঠক হিসাবে আমার পক্ষপাত যে পরের বই দুটির প্রতি, তার কারণ : কবিত্বের অপব্যবহার এ কাব্যে বড্ড বেশি। তাছাড়া শব্দ, পঙক্তি বা চিত্রকল্পের মাত্রাতিরিক্ত সজ্জা দেখে প্রায়ই ভাবতে ইচ্ছা হয় : প্রত্যয়ের ভিত যথেষ্ট মজবুত না হওয়ায় প্রকাশের তুলনায় গোপনেই তাঁর তখন স্বস্তি ছিল বেশি। দুর্বোধ্যতার অন্তত একটা কারণ বোধ হয় এই অস্বস্তিকর স্বস্তি। অন্য অনেক দুর্বোধ্য লেখকের ক্ষেত্রেও কি তাই নয়?
কবি হিসাবে তাঁর প্রত্যয় ও কুশলতা যে উত্তরকালে বেড়েছে, তার প্রমাণ পাই শব্দব্যবহারের ভঙ্গিতে। মাসুদ খান বরাবরই শব্দচেতন ও শব্দলোভী। তৎসম আর ওজোগুণসম্পন্ন শব্দের প্রতি তাঁর একটা সহজাত আকর্ষণ আছে। আর আছে এসব শব্দকে যুৎসইভাবে ব্যবহার করে তাক লাগিয়ে দেয়ার সাফল্য। প্রথম গ্রন্থেই এ লক্ষণ বেশ সুলভ। এখানে আবিষ্কৃত ও ব্যবহৃত বেশ কিছু শব্দ তাঁর উত্তরকালীন কবিতার মূলধন হয়েছে। তথাপি অব্যবহৃত-অভিধানসুলভ-দুর্বোধ্য শব্দের প্রতাপই প্রথম দিকে বেশি চোখে পড়ে। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক :
ক. আজ কি ত্র্যহস্পর্শ? [ত্রিজ]
খ. সহস্র বছর পরে, অশ্মীনিদ্রা শেষে— [হন্যমান]
গ. ঐ সটান প্রত্যালীঢ় ভঙ্গি তোর প্রধান নিষাদ [প্রতিষ্ঠান]
ঘ. হাম্মুরাবি ভেসে ভেসে আদিকৃত্যে যায় [সার্কারামা]
ঙ. গড়িয়ে নেমে আসে খঞ্জ লুসিফার
কাঁধের ডানে বামে আণব শীতকাল [সার্কারামা]
এ শব্দগুলো অপ্রচল ও দুর্বোধ্য তো বটেই, আবার বিশেষ কাব্যিকও নয়; এই অর্থে যে, যে ধরনের বহুবাচনিক সম্ভাবনা কোনো শব্দকে কবিতার সদররাস্তায় ঈর্ষণীয় করে তোলে, এগুলোতে তা অনুপস্থিত।
এবার শব্দের কুশলী ব্যবহরের কয়েকটি উদাহরণ :
ক. আরো কত-কত আবছা ব্রহ্মদেশে, রঙ্গপুরে
ব্যাপিত বগুড়াবর্ষে
অনেক নিম্নের দেশে, ম্লেচ্ছাবর্তে [বৃষ্টি-২]
খ. ঘনক তো গোলকেরই এক অপূর্ব অপিনিহিতি [বহুদিন পর আবার প্রেমের
কবিতা]
গ. একসঙ্গে তবু দোঁহে একই বুনো বাদলে স্নাতক। [একজন বর্ণদাসী ও একজন
বিপিনবিহারী সমাচার]
ঘ. বিরামচিহ্নের প্রভাবে প্রটোকলে প’ড়ে [সখাতত্ত¡]
ঙ. স্বজন যখন খোঁজে উত্তরাপথে
হারানো তখন দাক্ষিণাত্যে যায়। [তুমি তোমার সরাইখানা এবং হারানো
মানুষ]
চ. বর্ষাই মূল পাঠ্যকৃতি
মূল আখ্যানপাত্র
আর সব ঋতু পাঠসহায়িকা
টীকা-টিপ্পনী মাত্র। [বর্ষণবোধ]
এরমধ্যে ‘স্নাতক’, ‘বিরামচিহ্ন’ প্রভৃতি শব্দ প্রথম গ্রন্থেও আছে। এসব শব্দের পরবর্তীকালীন ব্যবহারকুশলতা আমাদের প্রস্তাবকে আরো স্পষ্ট করে।
প্রথম দিকে মাসুদ খানের লক্ষ্য ছিল এমন বিস্ময় হাজির করা, যা সম্ভবত পাঠকের অজানা এলাকা। কিন্তু পরে এসেছে চেনা অনুষঙ্গেই অভাবিতের আমেজ। বস্তুর অণুস্তরে কী সব রহস্য সঞ্চিত হয়ে আছে, সে সম্পর্কে না-ওয়াকিফ থাকা একজন পাঠকের পক্ষে দোষের— এমন বলা মুশকিল। কিন্তু আতাফল যদি কেউ নাও চেনে, কিংবা গ্রেনেড— তাহলেও ‘আতাফল’ কবিতা উপভোগে কোনো বাধা থাকে না। কার্যত আতাফল বা গ্রেনেডের বস্তুরূপ কিংবা অন্তস্থ সংগঠনের পরিবর্তে এ কবিতায় আছে এ দুই আপাত-যোগহীন অনুষঙ্গের এমন এক অভাবিত-অমিত যোগ, যা বস্তু দুটির সম্যক চিনপরিচয়ের উপর সামান্যই নির্ভরশীল। অতঃপর এই ‘ফল’ ‘মিরাকল’-এর মতো দারুণ এক অন্ত্যমিলে সওয়ার হয়ে যদি পৃথিবীর বহুদেশে ঝুলে থাকে ‘রূপক’ হয়ে, আর অপূর্ব ‘ইহফল’ গ্রেনেড যদি গেরিলা কিশোরদের হৃৎপিন্ড আকারে আতাফলের সমরূপ হয়ে ওঠে, তাহলে বাড়ির পরিত্যক্ত ভিটা হয়ে এক মোহনীয় ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া যায় লাতিন আমেরিকার কদলীবন পর্যন্ত। এই ভ্রমণে আপনার সঙ্গী হবে স্বর্গীয় ‘শান্তি’ আর পার্থিব— নাকি নারকীয়? —মানবিক ‘শাস্তি’র যুগলরূপ। ‘পুণ্য যাত্রীদলের’ অংশ হয়ে আপনি ‘আতঙ্কজনকভাবে’ পেছনেও পড়ে যেতে পারেন, কিন্তু ‘স্বর্গদ্বারে করাঘাত’-উদ্যত ‘ইহফলের স্মারকবার্তা’ আর ‘সন্ত্রাসের বাগ্বিধি’ এক রহস্যময় জটিলতার আকারে আপনার পিছু নেবে। ‘আতাফল’ কাব্যিক নির্মাণের এক চমৎকার দৃষ্টান্ত।
সন্দেহ নাই, কল্পনার বৈধতায় পাকাপোক্ত ইমান থাকলেই কেবল এরূপ নির্মাণ সম্ভব। এ প্রত্যয় আসে উপলব্ধির প্রগাঢ়তা থেকে। ধরা যাক, ‘বৃষ্টি’ সিরিজের কবিতাগুলোর কথাই। বর্ষা-বৃষ্টি-মেঘ-বিজলি মাসুদ খানকে অনেকদূর অধিকার করে আছে। এই পোড়া নগরে বৃষ্টির মতো প্রাণদায়িনী শক্তি আর কই! হয়ত আছে। কিন্তু এই কবি বাংলাদেশের খুব স্বাভাবিক বাস্তবতা মেনে নিয়ে— মনে নিয়ে— বর্ষারই শরণ নিয়েছেন। ‘প্রতিটি ঋতুতে একটু হলেও / থাকেই বর্ষাঋতু’— ‘বর্ষণবোধ’ কবিতার শুরুতেই এই যে প্রত্যয়ী প্রস্তাব, তা আসলে এক গোপন আকাঙ্ক্ষারই সূচনা, যে আকাঙ্ক্ষার ঘোষণা পাই কবিতাটির শেষ পঙক্তিতে : ‘দুনিয়ার যত ভীরু দেহ-প্রাণ / এস বৃষ্টিতে ভিজি’। সম্ভবত এরূপ প্রাণদ আরক রূপে আবিষ্কারের সাফল্যই তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে স্বরবৃত্তপ্রতিম নৃত্যচঞ্চল মাত্রাবৃত্তের অনেকগুলো সুখদ পঙক্তি। এ এক উদযাপন যেন। সে এমনই যে, ‘আষাঢ়’ শিরোনামের টানা গদ্যের মতো রচনাও অন্তর্গত বেগে-আবেগে চার-ছয় মাত্রার মতো দুলতে থাকে। আরো আছে ‘ধারাপাতগীতি : শ্রাবণে ও শৈশবে’— একই সাথে শ্রাবণ আর শৈশব উদযাপনের হিসাবি কাফেলা। কারণ : ‘ধারাপাত হতো পাঠশালা আর / পড়শির আঙিনায়’। এমন শ্রাবণের আশকরায় তো ‘সুরের সরস্বতী’ রচনা করাই যায়, আবিষ্কার করা যায় মনোমুগ্ধকর দ্বৈরথ :
ভেসে যায় কালো কাফ্রি মেঘেরা
গগনবিহারী দাস
ঊর্ধ্বে তাদের খাঁখাঁ বৈশাখ
নিম্নে শ্রাবণ মাস।
বলতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছি : ‘ধারাপাতগীতি’, ‘বর্ষণবোধ’ কিংবা ‘আষাঢ়’-এর মতো কবিতাগুলো নানা অর্থে আসলে ‘সিমেন্ট/আর.সি.সি.’ বা ‘পরমাণু’ কবিতারই সগোত্র। ছন্দ ও অনুভবের অন্তরঙ্গতায় আর দৃষ্টির প্রসারতায় অনেকগুলো নতুন পরত যুক্ত হয়েছে বটে, কিন্তু পরিবর্তনটা বৈপ্লবিক নয়। কবিত্বের অন্যতর বিপুল সম্ভাবনা বরং আসর জাঁকিয়ে বসেছে ‘বৃষ্টি’ সিরিজের কবিতা-চতুষ্টয়ে। সেখানে বৃষ্টি ঠিক উদযাপন নয়— কিংবা হয়ত উদযাপনই— কিন্তু অনিবার্য কৌশলের মতো ক্রিয়াশীল থেকেছে কবিতাগুলোর সর্বাঙ্গে। এমনই এক কৌশল, যা অলঙ্কারের মতো শোভমান, কিন্তু আলগা নয় কোনোমতেই। একে আলাদা করা যাবে না শরীর থেকে, করলেও অবশেষ আকারে পাওয়া যাবে না পৃথক কোনো অস্তিত্ব। মেঘ বা বৃষ্টিকে বেঁধে দেয়া যায় না দেশের সীমানা দিয়ে— এ সরল সত্যে ভর করে কবি বিচরণ করেছেন বিপুল দেশ আর মানসদেশে; পরদেশি মেঘকে স্বদেশে আর স্বদেশি আকুলতাকে সীমানার ওপারে পেরোতে দিয়ে বেশ তরিয়ে তরিয়ে দেখেছেন নিগূঢ় দৃশ্যাতীত দৃশ্যাবলি। সেই সাথে চারদিক ঝাপসা করে দিয়ে নেমে আসা বৃষ্টির কাভারে ডুব দিয়েছেন কথাহীন বাক্যের ক্রিয়াপদে। এত বিচিত্র রঙের বিভঙ্গে ম্লেচ্ছ বঙ্গদেশের কবিতাসুন্দরী বেশ অনেকদূর বশমানা লীলাবতীর মতো মৃদু হাসতে থাকে।
তাঁর তিনটি গ্রন্থেই এই বাগমানা হয়ে-যাওয়া কবিতার দ্যাখা পাওয়া যায় হরহামেশাই।
শুরুতে তাঁর কবিতার যে উপভোগযোগ্যতার কথা বলেছি, তার আরো খানিকটা সুলুক সন্ধান করা যাক এবার। এখানে আরেকবার নজর দেব শব্দভান্ডারের দিকে। দ্যাখা যাচ্ছে, পর্যাপ্ত বিশেষ্য মজুদ আছে তাঁর ভাঁড়ারে— একেবারে ‘বিশেষ্য’ শব্দটি পর্যন্ত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কিত শব্দরাশি— ক্রমশ কমে এলেও— প্রায় শেষ পর্যন্ত তাঁর সহায় হয়েছে। অধীত বিদ্যা থেকে পাওয়া আর প্রাত্যহিক জীবনাভিজ্ঞতার বিপুল ভাণ্ডারকেও তিনি অবহেলা করেননি। দৃষ্টান্ত হিসাবে দাঁড়ি, কমা, বাচ্য, বচন, অপিনিহিতি, বিশেষ্য, বিশেষণ, অব্যয়, সর্বনাম, ক্রিয়া প্রভৃতি শব্দের উল্লেখ করতে চাই, যেগুলো এসেছে বিশুদ্ধ ব্যাকরণের এলাকা থেকে। আমাদের মধ্যবিত্ত সব কবিরই এ শব্দগুলো জানা থাকার কথা। কিন্তু কাউকেই এ ধরনের সংজ্ঞাবাচক শব্দগুলো কাব্যিক প্রয়োজন ও সৌন্দর্যে ব্যবহার করতে দ্যাখা যায়নি। প্রচুর শব্দ তৈরি করেছেন তিনি— প্রধানত সমাস আর অনুচর শব্দ রূপে। বিশেষণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁর মুনশিয়ানা আছে। সংখ্যায় তারা প্রচুর, আচরণেও বিচিত্র। ‘ময়লা মানচিত্র’ কিংবা ‘মিথ্যা-মিথ্যা আবহাওয়া’র মতো সুস্বাদু বিশেষণ তাঁর কবিতার যে কোনো প্রান্তেই বেশ সুলভ। আমরা বলব, মাসুদ খান শব্দকুশলী কবি এবং শব্দ তাঁর কবিতায় বিশেষ মনোযোগের স্থল। অবশ্য ঠিক শব্দকেই তিনি কেন্দ্র করেছেন এমন নয়। কোনো কোনো কবি যেমন একটি বিশেষ শব্দকে কেন্দ্রে রেখে কথামালা সাজান, কিংবা সংখ্যাতীত প্রযত্নে কোনো নিরীহ শব্দকে বানিয়ে তোলেন কেন্দ্র— মাসুদ খানের কবিতায় তেমনটা কম চোখে পড়ে। কমের মধ্যে ‘আকারে বিকারে ভরা এই অনিত্য সংসার’ কবিতায় ‘বিকার’ শব্দটির কেন্দ্রত্বপ্রাপ্তি স্মরণ করা যেতে পারে। তবু বলতেই হবে, মাসুদ খান শব্দচেতন ও শব্দবিলাসী। আর এই যে তাঁর সামগ্রিক শব্দমুদ্রা— শব্দসংগ্রহ, শব্দব্যবহার, শব্দতৈরি— তার সবটাকে যদি বাঁধতে চাই একসূত্রে, যদি স্থির করতে চাই প্রধান ধর্মটি, তাহলে বলতেই হবে : প্রধান সূত্র বা ধর্ম শব্দের শ্রুতিমূল্য।
মাসুদ খানের কবিতার শ্রুতিমূল্য পাঠকমাত্রেরই কানে বাজবে। সম্ভবত নজরুলের পর আর কোনো বাঙালি কবি শ্রুতিমূল্যকে কবিতায় এতটা কাজে খাটাননি। এমনিতেই ওজনদার শব্দ তাঁকে টানে বেশি; আর সেই নির্বাচিত শব্দের শাসিত স্রোত ডানে বা নিচে প্রবাহিত হয়ে গেলে সুষম ধ্বনির প্রবাহরেখাটি কানে না এসে যায় না। প্রায়শই শব্দান্ত স্বরের ক্রমিক মিলে তৈরি হয় সুরের মূর্ছনা। আছে সমস্বর শব্দ, পুনরাবৃত্তি আর মধ্যমিলের কারুকাজ। শব্দালঙ্কারের প্রায় প্রতিটি ঘরানাই তাঁর বশ মেনেছে। এসব কারণে মাসুদ খানের কবিতার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পরিপূর্ণভাবে আস্বাদনের স্বার্থে শব্দ করে কানে বাজিয়ে পড়তে হয়। অন্যথায় এর মুনশিয়ানা অংশত অধরা থাকে। অন্য অনেক বৈশিষ্ট্যের মতো এ দিক থেকেও এ কবি পুরানা বাংলা কবিতার স্মৃতিবাহী। সরাইখানা ও হারানো মানুষ কাব্যের ‘সার্থবাহ’ কবিতাটি যদি পড়ি এ উপলক্ষে, তাহলে দেখব : সুমিতির এ বালাখানায় অনুপ্রাস, ব্যঙ্গ, প্রবচন ব্যবহার, স্তবকবিন্যাসকুশলতা, নাটকীয়তা ইত্যাদির উপাদেয় মিশেলে ‘অর্থ’ শব্দটির ধ্বনিগত আর অর্থগত দিকের যৌথ লীলা কায়ক্লেশহীন সচ্ছলতার মতো বয়ে গেছে। না, এ প্রাপ্তিকাণ্ডে কবিতাটির ভাবগত রসায়নে কোনো ছাড় দিতে হয়নি।
অবশ্য সব ক্ষেত্রে সাফল্যের শিকা এতটা ছেঁড়েনি। কখনো কখনো মনে হয় ধ্বনিসাম্য তৈরির বাসনা তাঁকে বেশ কতকটা উতলা করেছে, আর লোভী শিকারির মতো প্রতিশব্দ বা ‘অতিরিক্ত’ শব্দ জুড়তে জুড়তে তিনি পঙক্তিকে প্রসারিত করে যাচ্ছেন। প্রক্রিয়াটি সবসময় কাব্যিক ন্যায্যতার অধীন থেকেছে এমন বলা মুশকিল।
পুনরাবৃত্তি খুব প্রিয় অলঙ্কার তাঁর— কখনো পূর্ণ এক বা একাধিক পঙ্ক্তি, কখনো শব্দগুচ্ছ, কখনো একক শব্দ পুনরাবৃত্ত হয়ে কান ও মনের দরোজায় নাড়া দেয়। ঢাকার কবিতায় পুনরাবৃত্তির প্রধান ব্যবহার মূলত তালিকাধর্মিতার; অবশ্য অন্যবিধ তাৎপর্যও আছে। মাসুদ খান তালিকাধর্মিতার বদলে সেই অন্যতর সম্ভাবনাগুলোকেই পরীক্ষা করেছেন পূর্বাপর। এর মধ্যে প্রধান তাৎপর্যটি নিঃসন্দেহে ধ্বনিগত, অর্থাৎ সাঙ্গীতিক; আরো আছে বিশেষ দ্রষ্টব্যে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ, নাটকীয়তা বা বিশেষ বাগবিধি তৈরি, আর কখনো কখনো ধ্রুবপদের এক ধরনের সম্ভাবনাকে উস্কে দেয়া। পুনরাবৃত্তি অলঙ্কার তাঁর কবিতার সুখপাঠ্যতর অন্যতম প্রধান উৎস।
স্বচ্ছ ও প্রত্যয়ী ভাবনার সঙ্গে উপভোগ্য কাব্যকলার নিগূঢ় যোগসাজসই মূলত তাঁর বক্তব্যধর্মী কবিতাগুলোকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে শক্ত ভিতের উপর। তাঁর খুব প্রিয় শব্দ ‘ঝাপসা’, ‘ধোঁয়া-ধোঁয়া’ কিংবা বেশ ম্যাজিক্যাল ‘প্ররোচনা’। নিরেট বাস্তবকে বেশ কিছুটা দূরাগত বা রহস্যাবৃত করে তুলতে গৃহীত কলাকৌশল এসব শব্দের তাৎপর্যের মতো কাজ করেছে। ভঙ্গিটা দাঁড়িয়েছে এমন যে, ঠিক বাস্তব নয়, বাস্তবের প্ররোচনাই কবিকে দিয়ে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বলিয়ে নিচ্ছে। এ ধরনের কবিতার খাসা নজির ‘বাজার’। সাঙ্গীতিক প্রতিভা এ কবিতার অন্যতম প্রধান আকর্ষণস্থল; তার সাথে রূপক-মহিমা আর বিদ্রুপবাণ মিলে বর্তমান পুঁজিশাসিত টাকা-পীড়িত চঞ্চল জীবনধারার একটা ‘ময়লা মানচিত্র’ আঁকা হয়ে যায়। ‘ইতিহাস’ শিরোনামের কবিতাটির বর্ণনারেখা অবশ্য একেবারেই নিস্তরঙ্গ। সেই ফ্ল্যাট বয়ানের মধ্যে চাঞ্চল্য তৈরি করে ‘বৈজ্ঞানিক জ্ঞান’ নির্দেশিত এক ধরনের ইতিহাসের সম্ভাবনা। ইতিহাসের ‘কালো’ অধ্যায় আর ‘কালো’ মানুষ— এই দুই কালোর সাথে আলোর অনুপস্থিতিজনিত ‘কালো’র শ্লেষ বেশ জমে ওঠায় পাঠকের ধন্দ এবং জিজ্ঞাসা চনমনিয়ে ওঠে। সরাইখানা এবং হারানো মানুষ কাব্য থেকে এ রকম আরো অন্তত তিনটি কবিতার উল্লেখ করা যায়— ‘শূন্য’, ‘এক দেশ আছে’ এবং ‘সভ্যতা’।
যে দেশ ও কালে বসে লিখছেন কবি, তার প্রত্যক্ষ ছাপ কি তাঁর কবিতায় আছে? এক অর্থে এ জিজ্ঞাসা নিরর্থক। কবিতা যেহেতু আসমান থেকে নাজেল হয় না, পয়দা হয় মাটিতেই, তাই দেশ-কালের চিহ্ন সে শেষ পর্যন্ত এড়াতে পারে না। কিন্তু যাকে আমরা সমকাললিপ্ততা বলি, তা নিশ্চয়ই একটু অন্য ব্যাপার। মাসুদ খানের কবিতায় পাই তৃতীয় বিশ্ব আকারে অস্তিমান বাংলাদেশ, পুঁজি-নির্দেশত প্রথম বিশ্বের অধীনে যে অস্তিত্ব ভীত-সন্ত্রস্ত। খুব বাজার-শাসিত আর বিজ্ঞাপনমথিত হয়ে ঢাকায় আমরা যারা তাকিয়ে থাকি ওপারের দিকে, যাপন করি ‘উত্তর-আধুনিক’ বা ‘উত্তর-ঔপনিবেশিক‘ জীবন, তাদের সারবত্তা বা অসারতা তাঁর কবিতার বিষয় হয়েছে। তত্ত্ববাজি, তত্ত্বের ভেঙে পড়া আর নতুন তত্ত্ব গজানোর কেচ্ছাকাহিনিও আমলে আনেন তিনি। এর মধ্যে প্রায় অনিবার্যভাবে যুক্ত হয়ে যায় এককেন্দ্রিক বিশ্বমহিমার প্রচারিত বা গুপ্ত নানা নাটক। আর নাস্তিপ্রচারক পঙক্তিমালা তো আছেই। এসবকে যদি অন্তত অংশত সমকালীন বাস্তবতার সারাৎসার হিসাবে গণ্য করি, তাহলে দেখতে পাই : অনেকটা পরোক্ষে ঠাঁই নিয়েও মাসুদ খান সমকাল-উদাসীন নন। সত্যি বলতে কী, ‘এক দেশ আছে’ কিংবা ‘সভ্যতা’র মতো কবিতাগুলিতে এ কবি পালন করেছেন রীতিমত কালের চারণকবির ভূমিকা।
এই যে বর্তমানের চিহ্নগুলো কবিতায় ধরছেন তিনি, এগুলো ব্যক্তিগত উপলব্ধিজাত তো বটেই, কিন্তু দ্রষ্টা আকারে বাইরে থেকে দ্যাখা। যে কবি প্রাত্যহিক জীবনযাপনের ক্ষেত্রে নিজেকে এরূপ বাস্তবতায় আবিষ্কার করে হতচকিত হন, তার কবিতার শব্দ ও উপলব্ধিতে আরো অন্তরঙ্গ একাত্মতা উঠে আসার কথা। আধুনিক বিশ্বকবিতায় বা বাংলা কবিতায় স্বাভাবিক কারণেই এরূপ দৃষ্টান্তের অভাব নাই। মাসুদ খানের কবিতায় কিন্তু সেই একাত্মতার চিহ্ন পাই না। বলতে পারি, তাঁর কবিতায় তিনি প্রাত্যহিকতার— আরো বিশেষভাবে বললে— ব্যক্তিগত প্রাত্যহিকতার মুখোমুখি হন নাই। এটা অবশ্য তাঁর পূর্বাপর কবি-চরিত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আমরা আগেই দেখেছি, বিপুল বিস্তৃতির মধ্যে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে সামগ্রিক পাঠ প্রকাশেই তাঁর প্রবল আগ্রহ। তাঁর কবিতায় যে এক ধরনের ক্লাসিক সংহতি আর স্পষ্টতা— তারও উৎস সম্ভবত এই দৃষ্টিভঙ্গি।
মাসুদ খান প্রায় আগাগোড়া নৈর্ব্যক্তিক। প্রেমের কবিতা বা ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতির উৎসার তাঁর কবিতায় নাই বললেই চলে। দ্বিতীয় গ্রন্থের প্রেমে-সওয়ার-হওয়া কিছু কবিতায়ও খুব স্বাভাবিক কবিত্বেই তিনি প্রকাশ করেন অন্যতর অভিজ্ঞান। বেশ নৈর্ব্যক্তিক একটা ভঙ্গিতে রায় দেন তিনি। এমনকি যখন ধূলির আস্তরের ভিতর কোটি বছরের ইতিহাস ক্রীড়ারত দেখতে পান তখনো। সুধীন দত্ত বেঁচে থাকলে খুশি হতেন বেশ। নানান কারণে। এখানে বলা যাক, ব্যক্তিগত অনুভূতির কান্নাকাতর প্যাচপ্যাচানি থেকে বেশ অনেকদূর মুক্ত এই অনুজ কবির হিম্মত দেখে এলিয়ট থেকে ধার করা ‘নৈর্ব্যক্তিকতা’র একটা যুৎসই নজির খুঁজে পেতেন। দৃষ্টান্ত না বাড়িয়ে এখানে কেবল জানিয়ে রাখি, কাব্যশাস্ত্রে যাকে মহাকাব্যিক উপমা নামে চেনা হয়, সেই বিশেষণাত্মক, স্পষ্ট ও বিস্তৃত উপমার প্রতি প্রবল পক্ষপাত এবং এ ধরনের উপমার ব্যাপক সাফল্য মাসুদ খানের কবিতার ক্লাসিক বৈশিষ্ট্যের অনপনেয় স্মারক।
কিন্তু তাঁর মুদ্রিত পৃষ্ঠাগুলোতে যে ‘দেশ’ ফুটে ওঠে, তা এক কল্পবাস্তবের নিঃসংশয় প্রকাশে মায়া আর মোহের আকর। নিজের আবাসকে একবার তিনি চিহ্নিত করেছিলেন ‘সুদূর রূপতরঙ্গ গাঁ’ বলে, আর তাঁর সখার দেশটি দূরে ‘কাঁপা-কাঁপা রূপকাহিনির মতো কাঁপে’। আসলে এই সুদূর রূপনির্মিতিই মাসুদ খানের কবিতার শিরদাঁড়া। একদা, তাঁর কাব্যের প্রথম যৌবনে, বস্তুর অতি গভীরে বা দৃশ্যপটের নিহিত প্রাণবন্ততায় তিনি পেয়ে গিয়েছিলেন সুদূর সৌন্দর্যের মোক্ষধাম। কালক্রমে পাঠকের দৃষ্টির সমতলে নেমে এসেছেন তিনি, কিন্তু মোটেই বিসর্জন দেননি রূপতৃষ্ণা আর অচিনলোকের হাতছানি। সম্ভবত সেখানে— দূরত্বে— এক সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনকে পরম কাঙ্ক্ষিত রূপে লীলারত দেখতে পান বলেই তাঁর রূপবিলাসী মনটি মজে যায় সাবলীল ভঙ্গিতে। সেখানে বাংলার প্রত্নইতিহাস, কিংবদন্তি, কাহিনি আর প্রাচীন কবিতার ছায়ায় তাঁর নতুন নির্মাণ আমাদের চেনা ভুবনের কোল ঘেঁষে অচিনলোকের মতো বয়ে যেতে থাকে। ‘সেই এক দেশ আছে’ কবিতায় মানুষ ও প্রকৃতির যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয় এক স্বপ্নলোক। ‘একজন বর্ণদাসী ও একজন বিপিনবিহারী সমাচার’ কবিতায় অরণ্যের অসম্ভব গভীরে অভিনীত হয়ে যায় পুরানা প্রেমলীলার নতুন সব সংস্করণ। এসবের মধ্য দিয়ে অতীত-বাংলার কিংবদন্তিসকল ছবির মতো হাজির হতে থাকলে সেখানে ভবিষ্যতের আকাঙ্ক্ষারই যেন মূর্তি পায়। তাঁর পাঠকদের পক্ষে ভুলে যাওয়া অসম্ভব যে, তাঁর কবিতায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভিড় করে আছে যে মানুষেরা, তারা জাতিতে নিম্ন, আচরণে সরল, আর অবস্থিতিতে প্রাকৃতিক নিত্যতার অতি সন্নিকট।
এবং প্রথম যুগের বস্তুবিস্ময় ছেড়ে মানবমণ্ডলির সমতলে নেমে আসার পর তাঁর কবিতাও ক্রমে, ক্রমাগত হয়ে উঠেছে সহজ সারল্যের অভিসারী। এতসব সৌখিন রূপনির্মিতির পরও তাঁর বর্ণনাভঙ্গিতে কথকতার আমেজটি চাপা থাকে না। বেশ পরিমাণে ছন্দে ন্যস্ত এই কবি যে বাঁধা ছন্দের পর্বসাম্য আর ছক মাড়িয়ে যান প্রায়ই, তার এক কারণ কানের প্ররোচনা, অন্য কারণ কথকতার এ বিশিষ্ট ভঙ্গিটি জমিয়ে রাখার দায়। মাসুদ খান সহজ কবিত্বের নানা অনুগ্রহে ঈর্ষণীয় রকমে ধনী। ‘তুমি, তোমার সরাইখানা এবং হারানো মানুষ’ কবিতাটি সহজিয়া ঢঙের এক স্মরণীয় দৃষ্টান্ত। সংসারে স্থিতি আর স্থিতির মাঝে অচিনলোকের অবিরাম হাতছানি বোধ হয় সমাজ-সংসারের মতোই প্রাচীন। এমন কবি কি আছে, যার কাব্যলোক এ দুয়ের দ্বন্দ্ব আর মীমাংসাকে আমলে না এনে পেরেছে? আদতে সমাজের সাথে কবিভাষার অম্লমধুর সম্পর্কটিই তো এমন। মাসুদ খান খুব সাধারণ শব্দমালার ভাঁজে ভাঁজে ‘পথভোলা’, ‘প্ররোচনা’, ‘উন্মাদনা’, ‘স্নেহবর্ষ’, ‘হারানো’ ইত্যাদি নির্দেশকের ছায়ায় আর ‘সরাইখানা’র মতো ‘সামান্য’ এক রূপকের অভিভাবকত্বে একটি সমর্থ রূপকল্পকে নিখুঁত অবয়ব দিয়েছেন। ত্রিমাত্রিক পঙক্তির অপূর্ণ পর্বটি ছন্দদোলার সাথে সাথে কবিতাটিতে গতির সঞ্চার করেছে; আর নৃত্যপর চঞ্চল গতি আমাদের এ মর্মে আশ্বস্ত করেছে যে, কবি এই দ্ব›দ্বরত দুই পক্ষের কোনোটিরই অনুকূলে না গিয়ে একে উপস্থাপন করবেন জীবননাট্যের সারসত্য রূপে। একদিকে ‘কালে ও কালান্তরে’ কিংবা ‘উত্তরাপথ’ ও ‘দাক্ষিণাত্যে’র মতো শব্দ কবিতাটিকে দিয়েছে বিশ্বজনীন বিস্তৃতি; অপরদিকে ‘মাংস-কষার ঘ্রাণ পেয়ে পথভোলা’ পঙক্তির ঘ্রাণ-উৎসটি বাংলার ঘর-গেরস্থালির গোপন সমৃদ্ধির স্মারক হয়ে লগ্ন থেকেছে এই ভূমির। পৃথিবীর আর কোন দেশেই বা কষা মাংসের এমন মাহাত্ম্য প্রচারিত আছে? সরাইখানা ও হারানো মানুষ গ্রন্থে এরকম সহজ কবিত্বের দৃষ্টান্ত প্রচুর। এ গ্রন্থে মাসুদ খান তাঁর ইতিপূর্বে রপ্ত করা অধিকাংশ কলাকৌশল অক্ষুণœ রেখেছেন। বলা যায়, কৌশলগুলোকে কৌশলের পীড়ন থেকে রেহাই দিয়েছেন। সাথে যুক্ত হয়েছে আরো নতুন কিছু। এখানে তার কয়েকটি উল্লেখ করতে চাই।
গল্পের একটা আভাস তাঁর কবিতায় প্রথম থেকেই দৃষ্টিগোচর হয়। পয়লা পুস্তকের ‘পিঠাপুরাণ’ কবিতাকে স্মরণ করতে পারি এ মর্মে। অবশ্য গল্পের ধারাবাহিকতার তুলনায় ছেদ নির্মাণেই সেখানে তাঁর আগ্রহ সমধিক। দ্বিতীয় গ্রন্থে গল্পের মূর্তি ও কান্তি অধিকতর পষ্ট। আর তৃতীয় গ্রন্থে বেশ কিছু কবিতা পাচ্ছি, যেখানে গল্প তার বর্ণনাভঙ্গি, অঙ্গসংস্থান আর আদি-অন্তের স্বাভাবিকতায় একই সাথে পালন করে রূপক আর গল্পের ভূমিকা। ‘হোমাপাখি’, ‘ছক’, ‘নয়াতন্ত্র’ প্রভৃতি কবিতায় রূপকের বৈধতা মেলে জীবনোপলব্ধির গভীরতায়, আর গল্পটি ভর দিয়ে থাকে প্রধানত কথকতার সপ্রতিভ স্ফূর্তিতে।
‘আষাঢ়’ এবং ‘জলোচ্ছ্বাস’— অন্তত এ দুটি কবিতার উল্লেখ করতে চাই, যেখানে ইন্দ্রিয়াদির বিচিত্র রতি আর পারস্পরিকতায় একটা প্রচণ্ড বাস্তবতাকে সর্বশারীরিক অনুভববেদ্যতায় মূর্তিমান করার কসরত আছে। আমরা আগেই দেখেছি, মাসুদ খানের কাব্যজগৎ নানা অর্থে ধ্বনিময়। সেই ধ্বনি কখনো কখনো হয়ে ওঠে শব্দের অধিক ব্যঞ্জনাময়। ‘নামহারা, বাক্ ও বাক্যহারা’ কবিতায় কবি এমন এক অতীত যাচ্ঞা করেছেন, যেখানে নাম বা শব্দের অধিকার কোনো অস্তিত্বকে কলুষিত করেনি। মেঘের ডাকে সৃষ্টির ঊষালগ্নের সেই ধ্বনিব্যঞ্জনাকে মজুদ দেখতে পেয়ে তিনি উল্লাস বোধ করেন। এ দুটি কবিতায়ও শ্রবণেন্দ্রিয়েরই প্রতাপ; কিন্তু দৃষ্টি, স্পর্শ আর ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের পরস্পর সংহতি ও বিপর্যয়— অনেকটা চলচ্চিত্রের মতো— একটা পরিস্থিতিকে জান্তব তীব্রতায় উপস্থিত করেছে পাঠকের সামনে। ‘জলোচ্ছ্বাস’ কবিতার ‘খুব চেষ্টা হচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই কথাকে কাটছে না কোনো কথা, বাক্যে এসে মিশছে না কোনো বাক্য’-এর মতো পঙক্তি কবিতাটিকে নিয়ে গেছে পরিপ্রেক্ষিত-অতিক্রমী অন্যতর মহিমায়।
মাসুদ খান যে উত্তরকালে ক্রমে সহজ কবিত্বে ভর করেছেন, তা সহজেই নিশ্চিত করে বলা যায়। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যকারণগত কোন ধরনের বাস্তবতা এই রূপান্তরের হেতু— তা বলা মোটেই সহজ নয়। অনুমান করি, ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতার যে ধরনের গহ্বর থেকে জন্ম নিয়েছে আমাদের জনগণ-বিদ্বেষী কবিকুল— একধরনের উচ্চম্মন্যতার ছত্রছায়ায় প্রসারণের তুলনায় সঙ্কোচনেই যে কবিদের আনন্দ ও সিদ্ধি— সেই গহ্বর সম্বন্ধে সুচেতন অবস্থান গ্রহণ তাঁর এ পরিবর্তনের পক্ষে প্ররোচনা দিয়ে গেছে।
‘অনর্থবাতাস’ কবিতায় পশ্চিমের বদলে কবি কি কিছু পূর্বে পাড়ি জমিয়েছেন? —
এ নহে পবন বন্ধু, এ যে প্ররোচনা, দূরাগত, ভেজা-ভেজা!
তদুপরি ভিনদেশী হাওয়া! বড্ড উসকানিমূলক—
সাধ জাগে সব ছেড়ে-ছুড়ে আজ বৌদ্ধ হয়ে যাই পুরোপুরি সহজিয়া …
আউলাঝাউলা হয়ে রোহিংগা-রাখাইন হয়ে ঘুরে বেড়াই পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে …
এ কবিতায়, এবং আরো অনেকগুলোতে, এই কবি বিদ্যমান ‘সভ্যতা’, ‘ভালোত্ব’, ‘স্বাভাবিকত্ব’ প্রভৃতি ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর বেশ বড় সহায় হয়েছে বাংলার পুরানা ভাবের পরিমন্ডল।
নদীকূলে করি বাস কাব্যেই এ ভাবমণ্ডলের একটা দূরাগত ছায়া অনুভব করা গেছে। ‘বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা’, ‘সহবর্ণা, সহজা আমার’, ‘লীলা’ প্রভৃতি কবিতায় মানবিক সম্পর্ক ও জীবনচর্যা এরকম পুরাতন কিন্তু নতুন রসাবেশে হাজির হয়েছে। সরাইখানা ও হারানো মানুষ কাব্যের ‘শৈবালিনী’, ‘আবর্ত’, ‘নদী ও ডাঙার কাহিনি’, ‘পরমাপ্রকৃতি’, ‘নামহারা, বাক্ ও বাক্যহারা…’ প্রভৃতি কবিতা পড়ে বলতে ইচ্ছা হয় : এক বিরাট কাব্যখনি নতুন রূপে ও ঘ্রাণে ক্রমশ উন্মোচিত হচ্ছে এ কবির কাব্যভুবনে।
মাসুদ খানের কাব্যালোচনা এখানেই শেষ হতে পারত। কিংবা আরো আগেই। কিন্তু তাঁর পাঠকমাত্রই কবুল করবেন, এ কবির নদীতীরে দু-এক প্রস্ত পরিভ্রমণ ছাড়া এ আলোচনা শেষ হবার নয়।
নদী, নদীকূল আর নদীর ওপার বিচিত্র সব মোহনমায়ার মুরতি ধরে আগাগোড়া হাজির থেকেছে মাসুদ খানের কবিতাবিশ্বে। বলা যায়, নদীই তাঁর সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভূগোল। কুহকী নদীসমুচ্চয় প্রকৃতির বহুবর্ণিল আভরণ-বৃক্ষরাজি-পাখপাখালি আর নিরাভরণ মানবসকল সমেত খুব জরুরি কিন্তু বিলাসী উপাদানের মতো হাজির থেকেছে তাঁর কবিতার শিরদাঁড়া বরাবর। নদীকূলে বাস শুরুর আগে থেকেই মসুদ খান তাঁর মানস-বসতিতে নদীর নিয়তি নির্দিষ্ট করে নিয়েছিলেন। যেন সজ্ঞাবলে তিনি পৌঁছে গেছেন এ সিদ্ধান্তে যে : এই নদীবাহিত ভূভাগ আর জনজীবনের কাব্যগাথা নদী ও নদীতীর ছাড়া বড্ড শুষ্ক আর খাপছাড়া ঠেকবে। সম্ভবত হুমায়ূর কবিরই প্রথম পুব বাংলার জনজীবন আর কাব্যের যৌথ আবহে নদীর অপ্রতিহত উপস্থিতির কার্যকারণ নির্দেশ করেছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পূর্ববঙ্গে অসংখ্য বাস্তব আর মানসনদীর বরাভয় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। মাসুদ খানও অন্য কারো কারো মতো নদীকে শিরোধার্য করলেন। আর দেশি-বিদেশি নদী, কল্পনার নদী, পুরাণের-রূপকথার নদী বিশ্বস্ত সহচর হয়ে পরিমিত লয়ে বয়ে গেল তাঁর যাত্রাপথ বরাবর।
এক অর্থে সে যাত্রাপথে তাঁর নদীগুচ্ছকে চিনে নেয়া আসলে তাঁর কবিতার বিচিত্র বাহারেই লিপ্ত হওয়া। কবিতার বিচিত্র মতির সাথে সাথে বদলে গেছে নদীরও রূপ-রং-গতি। সেই পাখিতীর্থদিনে-র কালেই তাঁর কন্যা বারবার ঘুমিয়ে পড়েছে নদীতীরে, আর, জেনে ফেলেছেন কবি : ‘নদীকূলেই বাস চিরদিন আমাদের’; সঙ্গে এও মেনেছেন : ‘একেবারে নদীতীরে নয়, একটু দূরে’। ‘ত্রিজ’ কবিতায় পুনর্ভবার জলে নদীর খুব অভ্যন্তরে আলো আর সৃষ্টির মিছিলকে একাকার মনোকাল্পনিক যে ছবিতে উদযাপন করেছেন কবি, সেই নদী বাস্তবের খানিকটা দূরই বটে। অতঃপর নদীতীরে নিবাস গড়তে এসে ছোট্ট ছিমছাম নদীগুলোর সাজানো কোল ঘেঁষে তাঁর বিচিত্র লীলালাস্য চলে অনেকদিন। এখানে লঞ্চঘাট আর বন্দরে দু একবার শান্ত-নিরুদ্বেগ প্রবাহিণীর বাস্তবের ছবিটি আব্রুহীন দ্যাখা দেয় বটে, কিন্তু মোটের উপর মিষ্টিমধুর জলধারার খুব ব্যত্যয় তাতে ঘটে না। এমনকি তৃতীয় গ্রন্থের ‘ধীবর’ কবিতায়ও পাই এক মায়াবী নদী, মাছ-শৈবাল-জাল-তেঁতুলগাছ-কুমির মিলে যে নদী হয়ে উঠেছে ভাগ্যের দয়াপুষ্ট ধীবরের প্রেমিকার মতো মনোহারিণী। তবু দ্বিতীয় গ্রন্থেই নদী শব্দার্থ ও ব্যঞ্জনার্থের বিবিধ মন্ত্রণায় অংশ নিতে থাকে নানা অন্তর্নিহিত প্রযোজনায়। ‘সখাতত্ত্ব’ কবিতায় নদী আচানক রূপ বদল করে করে পালন করে যায় দরকারি সব ভূমিকা— কখনো সুদূরে বয়ে গিয়ে অচিন প্ররোচনার উৎস হয়, কখনো মনুষ্যকুলের পুরানা-বিদ্যমান-সম্ভাব্য জীবনপথের রূপক হয়ে ওঠে, কখনো বা নির্দেশ করে উদ্যমী নারী-পুরুষের যৌথ কর্মক্ষেত্র। ‘সখাতত্ত্ব’ কবিতায় প্রেমাকুল আবাহনের ছলে চলেছে আপন অস্তিত্বের এক প্রাণবন্ত জরিপ— সম্ভবত উপনিবেশ-উত্তর উপনিবেশের, এই বাংলাদেশের ব্যাপক-গভীর সমীক্ষা। নদী— তার গায়ে লেপ্টে থাকা বিপুল তাৎপর্যের ঔদার্যে— সেই সমীক্ষায় যোগ্য সারথি হয়েছে।
অবশ্য এ নদীও যতটা সম্ভব অচিনলোকেরই বাসিন্দা। যে নদীকে আমরা হরহামেশা কূল ভেঙে বা উপচে উঠে বয়ে যেতে দেখি আমাদের ভূমির গভীর মাঝদেশ বরাবর, কিংবা মৃত নদীর কারুণ্যে টের পাই অস্তিত্বের অশনি-সংকেত, এ নদী সে নদী নয়। সে নদীর দ্যাখা মিলবে সরাইখানা ও হারানো মানুষ-এ। সেখানে নদী বেয়ে আমাদের ঘরের খুঁটি হওয়ার জন্য ভেসে আসবে শালগাছ, আমাদের আকর্ষণের উৎস হয়ে কিন্তু আসলে নিষ্ফলা ভেসে আসবে ‘শালপ্রাংশু মরদেহ’, আসবে হলদে পাখির মতো রমণীয় মানবী, আর রাজপুরুষের মতো প্রবল-প্রতাপ মানব। কালপরিক্রমায় পুরানা আদি স্টকে যুক্ত হওয়া এসব উপচার মিশে যাবে এই নদী-বিভূষিত সজীব ডাঙায়। আমরা এখানে ‘নদীমাতৃক’ কবিতার কথা বলছি, বাস্তবের খুব অন্তরঙ্গ কয়েকটি রেখা যেখানে সহসা প্রতীকী ব্যঞ্জনায় বিকশিত হতে হতে হয়ে উঠবে বিপুল এক জনগোষ্ঠীর আখ্যানমালা। আর বাবার দীর্ঘশ্বাস-ঝরানো সাবানগাছটি ‘ময়লা সন্তানদের ততোধিক ময়লা পোশাকগুলো’-তে থিতু হলে এ আখ্যানে ধরা পড়বে বাংলাদেশের মুখ।
এই মুখই সম্ভবত মাসুদ খানের আগামীদিনের গন্তব্য।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
১. ‘নদীমাতৃক’ ও ‘জলোচ্ছ্বাস’ কবিতা দুটির পাঠে আরিফ হোসেন রুবেলের সহায়তা নিয়েছি।
২. নদীকূলে করি বাস গ্রন্থের শেষ প্রচ্ছদের সংক্ষিপ্ত গদ্যভাষ্যটি— সম্ভবত কবি-প্রাবন্ধিক-সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফের লেখা— কোনো কোনো অন্ধকারে আলো ফেলে গেছে।
৩. মাসুদ খানের সাথে আলাপচারিতায়— মজিদ মাহমুদ সম্পাদিত পর্ব নভেম্বর ২০০৭ সংখ্যায় মুদ্রিত— কিছু বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। উল্লেখ্য, অতি-বিস্তৃতির আশঙ্কায় আলাপচারিতায় উঠে আসা কিছু প্রসঙ্গ এ লেখায় পরিহার করেছি।
লেখক-পরিচিতি:
। মোহাম্মদ আজম। প্রাবন্ধিক ও গবেষক। জন্ম ২৩ আগস্ট, ১৯৭৫ নোয়াখালীর হাতিয়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত।ছোট-বড় শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। অনুবাদ করেছেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু তাত্ত্বিক রচনা। প্রকাশিত গ্রন্থ বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন ও রবীন্দ্রনাথ [২০১৯]; বাংলা ও প্রমিত বাংলা সমাচার [২০১৯]; কবি ও কবিতার সন্ধানে [২০২০]; হুমায়ূন আহমেদ : পাঠপদ্ধতি ও তাৎপর্য [২০২০]; বিষয় সিনেমা : তিনটি অনূদিত প্রবন্ধ [২০২০]। সম্পাদিত গ্রন্থ নির্বাচিত কবিতা : সৈয়দ আলী আহসান [২০১৬]।