ধূসর রন্গা কন্ক্রীট-এর পিচ্ছিল গা বেয়ে গড়িয়ে পড়া সূর্যরশ্মি—কখনও হলুদ, কখনও কমলা, কখনও লাল আবার কখনও সবুজ। বর্ণহীন কন্ক্রীটে নানা রং-এর এই বিচ্ছুরণ প্রমাণ করে দেয় ম্যাটেরিয়াল নির্বাচনে লুই কান কতটা সার্থক। জাইগ্যানটিক ত্রিকোনোমিত্রিক পাঞ্চ, ত্রিভুজাকার, বৃত্তাকার আলো-ছায়ার খেলা, পানির উপর শান্ত প্রতিবিম্ব। অভিজাত রুপালি কন্ক্রীটকে ঘিরে থাকা মাটির কাছাকাছি লাল ইটের দালান। ঘোরলাগা মুগ্ধতা আমার চোখে। বাবা বললেন “ এই যে সোনালি পানি, রুপালি কন্ক্রীট, রক্তরাঙা ইট, এই-যে আলো-ছায়া, একে অপরের সাথে যেন কথা বলছে সর্বক্ষণ, এই-যে দৃশ্যপট, একি কোনো শিল্পীর আঁকা পেইন্টিং-এর চেয়ে কম? এ স্থাপত্য কি কবিতা নয়? ‘তুমিও তো স্থাপত্যের কবি হতে পারো!”, ঠিক তখন থেকেই শুরু আমার স্থপতি হয়ে ওঠার পণ।
লুই আই কান-এর সাথে আমার সম্পর্কটা ছোটবেলার। তখন কবিতা লিখি, নানা রং-এর চক দিয়ে ছাদে ল্যন্ডস্কেপ করি, না বুঝেই নগর নকশা, বাড়ি-ঘর আঁকি। কখনও ভাবি কবিই হবো, লেখক হবো, সাহিত্যে পড়াশোনা করবো, আবার কখনও ভাবি সুন্দর সুন্দর ভবন, অট্টালিকা ডিজাইন করবো, স্থপতি হবো, পেইন্টার হবো। বাবা হাত ধরে যেদিন নিয়ে গেলেন সংসদ ভবনে, তখন আমার বয়স কতই-বা, আট-নয় বছর, চতুর্থ কি পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্রী। তিন-চার ফুট উচ্চতা নিয়ে যখন লুই আই কানের ম্যাসিভ মনুমেন্টাল অসামান্য কীর্তি, সংসদ ভবন-এর সামনে দাঁড়ালাম, বিন্দুমাত্র ভয় কিন্ত গ্রাস করেনি আমাকে। ঐ বিশাল উচ্চতার কাছে নিজেকে একদমই ছোট মনে হয়নি। বরং যেন বটগাছের নীচে পরম ভরসায় দাঁড়িয়েছিলাম। এই অসম্ভবটি সম্ভব হওয়ার কারণ ওই অনবদ্য সৃষ্টির সাথে মিশে থাকা লুই আই কানের হৃদয়, যে পরম মমতায় বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়কে ধারণ করেছিলেন। তাদের ভাললাগা, কমফোর্ট জোন, কৃষ্টি আর একাত্মবোধের সাথে একাত্ম হয়েছিলেন।