অনেকক্ষণ ধরে খাতার পাতা খোলা আর আবজানোর খেলা আপনি খেলে চলেছেন, কবিতাখাতা, লিখতে পারছেন না। লেখা তো দূর, আমরা দেখতে পাচ্ছি, একটা আঁচড়ও কাটতে পারেননি দীর্ঘ এক ঋতু। শঙ্কায় আতুর আপনার মনে থেকে-থেকেই উঁকি দিচ্ছে সপ্রশ্ন সংশয় : চিরতরে বাঁজা হয়ে গেল বুঝি কলম ও করোটি! আর মনে মনে ভাবছেন, লিখে-যাওয়া আসলে একটা প্রকাণ্ড সাহসের কাজ। বুদ্ধিমানের সাহস দিয়ে গদ্য লেখা যায়, কবিতা নয়। কবিতা লিখতে গেলে চাই বোকার সাহস। বোকা কিচ্ছুটি না-ভেবে, আগুপিছু পরিণতিচিন্তা ছাড়া, ঝাঁপ দিতে পারে অতলান্তিকে; সাঁতার জানে কি না, নাও বাইতে পারে কি না লগি-বৈঠা ঠেলে, সেই-সময় এসব তার মনেই আসে না; জল দেখলেই ঝাঁপাতে চায়। আগুন দেখে তার পুড়ে যাবার ভয় নয়, নাচতে ইচ্ছে হয়। তা না-হলে তাকে বোকার সম্মান দেবে কেন জগৎ? ইত্যাদি, এইসব, ভাবছেন আপনি বিরামহীন আর খাতার পাতা খোলা-বুঁজানোর খেলা খেলে চলেছেন।
Category: গদ্য
কমেন্টস অন পোয়েটস :: ইমরুল হাসান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লিগাসি
কবিতা কয়েকটা নির্দিষ্ট ছন্দে লিখা যায় না; কবিতা লিখার ভিতরেই অসংখ্য ‘ছন্দ’ থাকে। এই অসংখ্য ছন্দ আবিষ্কার করা যাইতেই পারে। কিন্তু ছন্দের ভিতর দিয়া কবিতা আবিষ্কৃত হবে – রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্বাস, আমার নাই। এই ‘সত্য’ বাঙালি কবিরা যখন ফিল করতে পারবেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা তখন স্পষ্টভাবে পড়া সম্ভব হবে। কিন্তু যাঁরা ছন্দের ভিতরে কবিতারে আটাইতে চান; তারা কেমনে রবীন্দ্রনাথরে না-পইড়া থাকতে পারেন! একজন কবি খালি নোবেল পুরষ্কার এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক সাফল্য পাইছেন বইলা তারে এতোটা ঈর্ষা, অপমান ইত্যাদি করাটা ঠিক না।
২০১৪
তিনটি প্যারাবল :: ভাষান্তর : বদরুজ্জামান আলমগীর
বাইবেলের ল্যুক চ্যাপ্টারে আমরা প্রথম প্যারাবলের দেখা পাই। আদিতে নৈতিকতা শিক্ষা দেবার একধরনের গল্প ছিল প্যারাবল- অনেকটাই ফেবলের জ্ঞাতি ভাই। কালক্রমে প্যারাবল অনেক অদলবদল, অভিজ্ঞান ও দার্শনিক মোকাবেলা সঙ্গে নিয়ে আজ এক পরিপূর্ণ, পরিপক্ক মাধ্যম হিসাবে উঠে এসেছে। শুরুতে প্যারাবল ধর্মীয় নৈয়ায়িকতার নিশ্চিদ্র অঞ্চলে বাস করতো; ফলে তার সঙ্গে থিয়োলজিক্যাল জ্ঞানবত্তার কোনো তফাৎ ছিল না, কিন্তু এখন প্যারাবল প্যারাডক্স ডিল করতে জানে, পলেমিকস আহবান করে, এমনকী ধর্মীয় চৈতন্যের বিপক্ষ দার্শনিক ঘরানা তৈরি করতেও দ্বিধা করে না; সে আজকাল সহসা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকাণ্ড বিনির্মানেও ব্রতী হয়।
ফরমালিনশালীন :: অমিতাভ পাল
আজকাল পচা মাছ কেনার জন্য বাসার লোকের বকা আমাকে খেতে হয় না বললেই চলে। বরং আয়েশ করে মাছ খেতে পারি। কিন্তু অবস্থাটা এরকম ছিল না বছর দশেক আগেও। তখন প্রায়ই মাছ কিনে আনন্দ আর উৎফুল্লতায় ভরে উঠে একটা নির্ভার বেলুনের মতো বাসায় ফেরার পর চুপসানো বেলুনে পরিণত হতে আমার দেরি হতো না। কারণ ওই মাছ। চকচকে খোলসের ভিতরে তারা ঢেকে রাখতো তাদের পচা শরীরটাকে। আর আমার সব অভিজ্ঞতাকে বুড়া আঙুল দেখিয়ে তারা ডাস্টবিনে চলে যেতো হাসতে হাসতে। আর আমরা সপরিবারে একটা আমিষহীন রাত্রি যাপন করতাম কেবলমাত্র আমারই দোষে।
ট্রিবিউট টু উৎপল ও বঙ্গজ অন্যান্য তরুণকুমার :: জাহেদ আহমদ
‘ভোরবেলার রৌদ্রে বসে বাজার’ যেই দেশে, সে-দেশ হয়তো ‘অন্য দেশ, অন্য কোনো রাজার’, সেইখানে বয় ‘চিরদিনের নদী’ এবং ওড়ে মেঘবাহিতা ‘পাখি’, কিংবা কাকজ্যোৎস্নারাত্তিরের শেষে ‘ভোরবেলা গাভীর স্বননে’ জেগে-ওঠা মানুষ ও মোরগের যথাক্রমে গর্গল আর বাঙ, সেই দেশ রঙিন অথবা রঙহীন ধর্তব্য নয়, সেই দেশে ‘তোমার স্বর ধ্বনিজাল — প্রতিধ্বনিজাল — পাতায় শিশিরবিন্দু মুছে যায় — মুছে যায় পলাতক কিশোরের ভীরু কণ্ঠ, সমস্ত দুপুর ভরে শরবন ক্ষয়ে যায়’, এবং ‘আমার চেতনা শুধু শব্দের করস্পর্শে ভেঙে যায়’ যেই দেশে যেয়ে, সেখানে ‘নির্জন বালির বুকে পড়ে-থাকা নৌকাগুলি তোমাদের জানে’, এবং আমিও ‘তাদের ছায়ায় বসে’ গেয়ে গেছি বিরামহারা বাসনার গান ‘সারাদিন হৃদয়পণ্যের’,
জেমস জয়েস’র ইউলিসিস (পর্ব-৭) :: পায়েল মণ্ডল
এপিসোড—৩ (প্রটিয়াস): স্ট্রিম অফ কনশাসনেসের এমন অনবদ্য লেখনী যা এই এপিসোডে লেখা হয়েছে, তা অন্য কোনো লেখকের লেখায় পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। জয়েস ভাষার কুলীনতা ভেঙ্গে দেন, তিনি সৃষ্টি করেন তাঁর নিজের ভাষা, যাতে মানা হয় না ব্যাকরণ। তিনি নির্মাণ করেন নতুন নতুন শব্দ একাধিক শব্দ একত্রিত করে। আর এক স্ট্রিম অফ কনশাসনেসের ধারক ভার্জিনিয়া উলফ কিন্তু জয়েস থেকে একেবারে ভিন্ন ভাষা ব্যবহার করেছেন। তিনি জয়েসের মত কোনো এক্সপেরিমেন্টে যান না।
এপিসোড তিন-এ আমরা দেখি মাত্র একটি এ্যাকশন আর বাকী অংশ জুড়ে বর্ণিত হয় স্টেফান ডেডেলাসের চিন্তাপ্রবাহ। তার মনোলগ, ডায়ালগ, অন্তর্জগতের কথোপকথন। স্টেফানের ভাবনা সরলরৈখিক ভাবে এগোয় না বরং সেটা এগোয় হঠাৎ দিক বদলে। জয়েস চিন্তার জিগ’স প্যাঁচগুলোকে একে একে জোড়া দিয়ে ভাবনার একটা অবয়ব নির্মাণ করেন পাঠকদের জন্য। চিন্তাকে চিত্রিত করেন প্রতীকী শব্দে। প্রতীকী শব্দে বিশ্লেষণ করেন দর্শন। তিনি সৃষ্টি করেন এক নতুন ভাষা, জয়েসিয়ান ভাষা। আর এখানেই জয়েস ও অন্য স্ট্রিম অফ কনশাসনেসের লেখকদের মাঝে নিজের অনন্য পার্থক্য আঙ্গুল দিয়ে সগর্বে দেখিয়ে দেন। তিনি বুঝিয়ে দেন তিনি এক এবং একক।
প্রগাঢ়তম বন্ধু :: অমিতাভ পাল
কবিতা কেনো লিখি—কবিতা লেখার শুরুর দিনগুলিতে এই প্রশ্নের জবাব দেয়া সহজ ছিল। কিন্তু যতোই দিন যাচ্ছে, যতোই জড়িয়ে যাচ্ছি কবিতার সঙ্গে, ততোই অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই প্রশ্নের উত্তর। কবিতা লেখার শুরুর দিনগুলিতে শুধু কি কবিতা লিখতাম? প্রেম করা, গান গাওয়া—এরকম আরো কত কাজে ছড়িয়ে পড়েছিল আমার হৃদয়। যৌবনের অফুরন্ত শক্তির প্রতাপে তখন যাতেই হাত দেই তাতেই সোনা ফলে। আর কী দৃপ্ত সব প্রতিজ্ঞার দল!
তারপর গড়াতে থাকা দিনগুলির সাথে সাথে ঝরে গেছে অনেক কিছু। আর তাতে ক্রমশ নিঃসঙ্গ হতে হতে যা থেকে গেল—অর্থাৎ কবিতা—সেইই হয়ে উঠলো প্রগাঢ়তম বন্ধু। কিন্তু কবিতা কেনো থাকে? কবিতাকে যে ভালোবেসেছে, কবিতার সঙ্গের স্বাদ যে পেয়েছে—সে আসলে কবিতাকেই বিয়ে করে ফেলে শেষ পর্যন্ত। আর কবিতাও ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে, জানে যুগ্ম হয়ে জীবন কাটাতে। তাই এই জুটির বিচ্ছেদ হয় না সচরাচর।
স্প্যানিশ আর্কিটেক্চার: একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত শহর আর কিছু রোমান্টিক অনুভূতি :: লায়লা ফারজানা
“The weeping of the one who weeps
with an eye whose tears flows endlessly
is not enough to lament the loss of such as Cordova
My heart is torn apart for its wise
and forbearing men, it’s men of
Letters and its men of taste” — Ibn Shuhaid, 11th century
জ্যোৎস্নাস্নাত রাত, পাহাড় বেয়ে নেমে আসা রাস্তার দুই ধারে হাজার তারার মত জ্বলছে ঝাড়বাতি গাছে গাছে। যেন পাহাড়ের বুকে তারকাখচিত শহর ঘুমায় আকাশে হেলান দিয়ে। কী এক কাব্যিক, ঐশ্বরিক সৃষ্টি। দৃষ্টিনন্দন শহর-সৃষ্টির এই সিদ্ধান্ত, এই আলোকসজ্জিত নগরায়নের উদ্ভাবন আজকের নয়, আজ থেকে শত শত বছর আগের একজন আবদ-এর-রহমানের (730 A.D.) দূরদর্শিতার ফসল । সেই স্বপ্ন ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা। স্বপ্ন ছিল তাঁর প্রিয় নগরী গ্রানাদা, কর্দোভা, আন্দালুসিয়া প্রজ্জ্বলিত মুখ নিয়ে, অনন্য সেরা শহর হয়ে বিশ্বের বুকে সাম্যবাদের বার্তায় মুখরিত থাকবে চিরকাল। মাথা উঁচু করে ঘোষণা করবে তার অস্তিত্ব আর মানবতার বাণী।
দেশান্তর এবং মেটাফর: গান ও গরিবির নাগরিক মোলাকাত প্রসঙ্গে :: সুমন রহমান
ভূমিকা: নগরগরিবের সাংস্কৃতিক পরিচয় সাম্প্রতিক বাংলা গানে কীভাবে উৎপাদিত হচ্ছে, এই ছিল আমার ডক্টোরাল গবেষণার বিষয়। এই বিষয়বস্তুর মধ্যে আমি প্রবেশ করেছিলাম উল্টো দিক থেকে, অর্থাৎ ঢাকা শহরের “আরবান ফোক” নামক এক ধরনের পপ গানের চলটি আমার নজর কেড়েছিল প্রায় এক যুগ আগে। নগরগরিব তখনো আমার চিন্তার মধ্যে নেহাত একটি উন্নয়নমূলক উপাদান হয়ে ছিল। আমি কাজ করতাম বস্তিবাসীর স্বাস্থ্য, পয়োনিষ্কাশন, কিংবা বস্তি উচ্ছেদ ইত্যাদি নিয়ে। এসব মুহূর্তে যখনি বস্তির কোনো ডেরায় ঢুকেছি উন্নয়নপ্রভুর জরিপ অথবা সাক্ষাৎকারের ছাপানো ফর্দ নিয়ে, অবাক হয়ে দেখেছি এতটুকু ডেরার প্রায় এক তৃতীয়াংশ জুড়ে ক্যাসেট আর ক্যাসেটপ্লেয়ারের মনোরম ডিসপ্লে। আধা মনোযোগে, আধা কৌতুকে তাদের গান শুনেছি বসে বসে: অচেনা শিল্পী, অদ্ভূত গায়কী, বিদঘূটে সব গান! বাংলা গানের যে রুচি আমার তৈরি হয়েছে রবীন্দ্র-নজরুল-হেমাঙ্গ-সলিল-সুমন-অঞ্জনবাহিত বিস্তীর্ণ পলিমাটিতে, এই গান সেখানে খাপছাড়া। এই দাপুটে গানের ধারা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের দাপুটে সংস্কৃতির ভেতর নিশ্চয়ই অনেক প্রতিপত্তি নিয়ে বেঁচে থাকবে, কিন্তু কেউ কি ভেবেছিল যে, গাজীপুরের কোনাবাড়ি থেকে প্রকাশ পাওয়া ইমনের এলবামের বিক্রিও লাখ ছাড়াবে, সিলটি শরীফের গানের সিডি বেচবার জন্য দেশের আনাচে কানাচে তার নামে আলাদা দোকান হবে, মমতাজের এলবামের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে, আর এই ‘এগজোটিক’ গানের বাজার বাংলাদেশের গোটা সঙ্গীতবাজারের প্রায় সত্তরভাগ দখল করে নেবে?১ আরবান ফোক গানের এই অগ্রযাত্রা নিয়ে নানান অবকাশে লিখেছি, ফলে বর্তমান পরিসরে সেই আলাপে বিস্তার ঘটাবার সুযোগ কম।২ বরং ঢাকায় নগরগরিবের সাংস্কৃতিক পরিচয় উৎপাদনে এই গান যেভাবে ভূমিকা রাখছে, সে বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণ হাজির করাই বর্তমান নিবন্ধের লক্ষ্য।
ম্যাসরিডিং, মিসরিডিং :: জাহেদ আহমদ
মানুষ আপোস করে বাঁচে, কবিতা কিন্তু আপোস চেনে না; — গ্যুন্টার গ্রাস্ বলেছিলেন কথাটা। প্রিন্সটন য়্যুনিভার্সিটিতে একটা ভাষণ দিচ্ছিলেন তিনি, বেশ অনেক-বছর আগে, সেই-সময়ের কথা। আমি অবশ্য ওই ইভেন্টে যেয়ে সরেজমিন প্রেজেন্ট হই নাই, ফিজিক্যালি ম্যুভ করার দরকারও হয় না আদৌ, অন্তত বক্তৃতা শোনাশুনিতে, অ্যাপ্সযুগে তো পড়া-শোনা-জানা ইত্যাদি ক্রিয়াকলাপে ফিজিক্যাল প্রেজেন্সের নেসেসিটি নগণ্যই; কিংবা আস্ত বক্তৃতাটাও শুনি নাই, আমি শুনেছিলাম কখনো কথাচ্ছলে সুমনের মুখে। সেইটাও ওই ইন্টার্ভিয়্যু মারফতে। একটা ইন্টার্ভিয়্যু পড়েছিলাম কবীর সুমনের, ইন্ডিয়ান বাংলা গানের বাগগেয়কার কবীর সুমন, প্রসঙ্গক্রমে সেখানে কোথাও কবীরজি স্পিচটার উল্লেখ করেছিলেন। মোদ্দা কথা, মানুষের বাঁচা আপোসের ভিতর দিয়া হলেও কবিতা অনাপোস। কবিতার বাঁচা আপোস দিয়া হয় না। কবি নিশ্চয় ব্যক্তিজীবনে আপোস করতেই পারেন, কিন্তু কবিতায় সেই আপোসের ছায়াপাত ঘটলেই ঘাপলা। যা-হোক। কবিতা আপোসবিরুদ্ধ বলেই কি কবিতার পাঠক সংখ্যায় চিরকাল অল্প? স্বভাবে আপোসকামী, কিন্তু লোক-দেখানিয়া ডাঁট বজায় রেখে চলতে-চাওয়া মানুষ কবিতার কাছ থেকে তাই কি তিনশ পঁয়ষট্টি কিলোমিটার দূরে থাকতে চায়? কে জানে, হতে পারে, হয়তো-বা।