ডোনাল্ড জাস্টিস যেন ঠিক কবি নন—স্মৃতির কারবারি। স্মৃতি নিয়ে এত কায়কারবার অন্য কোনো কবি করেছেন বলে ত্বরিত মনে পড়ে না। ব্যাপারটা বেশ বিস্ময়কর—স্মৃতির বাগান গোছাতে গিয়ে তিনি কখনোই পদ্যকার হয়ে ওঠেননি, কবি-ই থাকেন, কখনও হেলে পড়েননি। কবিতার বিন্যাস, আঁটসাঁট বাঁধন অষ্টপ্রহর ঠিকঠিক ধরে রাখতে জানেন: ধারালো, নির্মেদ কাঠামো, মিটার, চিত্রকল্পের গড়নে সৃজনশীলভাবে মেধাবী, লিখেছেন ঘনবদ্ধ হিসাবী সেস্টিনা, সনেট, সেই সাথে মুক্তছন্দের কবিতাও। ডোনাল্ড জাস্টিস সম্পর্কে মার্ক স্ট্র্যান্ড’র বিবেচনাটুকু তুলে আনা যায়: কবিতা পড়াকালে আমাদের মধ্যে যে প্রত্যাশা জাগে—জাস্টিস তার সবই কবিতার পাতে তোলেন, অন্যদিকে স্মৃতির কথা বলতে বলতে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও কবিতাকে মনমরা করে তোলেন না—বেদনা ও আনন্দের যৌথতায় ডোনাল্ড জাস্টিসের কবিতা এক স্মরণযোগ্য ঘটনা হয়ে ওঠে।
শৈশবে বন্ধুর প্রয়াণ স্বর্গে শ্মশ্রুমণ্ডিত ওদের সঙ্গে মোলাকাত হবে না, নরকে সূর্যধ্যান করছে তারা—এমনও যেন না দেখি; জড়ো হোক সুনসান ইশকুলের মাঠে চন্দ্রিমা শেওলায় হাতে হাত ধরে একটি বৃত্তে চনমনিয়ে উঠুক তারা হয়তো পরস্পর নাম ভুলে গ্যাছি, আকৃতি মনে নাই এসো স্মৃতির ঢলে নামি, টুকরো টুকরো ছায়াদের কুড়াই। ছোটদের ভূমিবিন্যাস গুটিকয় পাইন গাছ, একটা খাল, টুকরো টুকরো আকাশ পাইন গাছগুলো গরীব গোবরাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই ঝড়ো বাতাসের নিচে ওখানেই ছিন্নমূল মানুষগুলো গাদাগাদি করে পড়ে থাকে। বাচ্চাকাচ্চারা কুকুরের সঙ্গে খেলায় মাতে, দৌড়াতে দৌড়াতে কাদায় লুটোপুটি হয় আবার হয়তো খালে লাফিয়ে পড়ে। লাল খেলার বল পা বদল হতে হতে, হাত থেকে হাতে হঠাৎ আগাছা জঙ্গলে হারায়। এখন শীতকাল, চলে যাবার—হারিয়ে যাবার বেলা। যেতে নাহি দিবো হায়—মুষড়ে কাঁদে ভাঙা ঘরদোর, ডুকরে ওঠে শিশুদের দল—ছোট লাল বল, আকাশের ছোট ছোট ছোপ মিলাবে দিনশেষে অনন্তের ঠিকানা আহা অসীমা। প্রণয়ের নকশা তোমার মুখ অন্য সবার অবয়ব থেকে বেশি কিছু যে-সব জায়গা স্মৃতির বুনিয়াদ থেকে অনেকটাই দূরে সরে গ্যাছে ঘুমের মধ্যে আলো-আঁধারি অঞ্চলে আবার এসে মৃদুমন্দ উঁকি দেয়— তোমার মুখমণ্ডলে তাদের ঠিকানা জড়ানো থাকে, যারা জেগে আছে—তারা এর মোরতুবা জানে না। তোমার মুখের ভরসায় আমি জেগে উঠি— তাতেই অবিকল মনে পড়ে যায় দূরের সাগর সৈকত আর গহীনে অতলের নকশা। কাঠমুন্ডু আমরা পাহাড়ের উপরে উঠে এসেছি তার বেশি কিছু করার নেই। পাহাড়ের নিচে নেমে আসা এক সমূহ লাঞ্চনা ফুলে ফুলে পাদদেশ ঢলে ঢলে আছে কেউ ভেবে বসে তুষার—তুষার জমে রয়েছে বুঝি। আগে ব্যাপারটা অন্যভাবে ছিল— তুষারের নীরব জমজমাটের মাঝখানে পাহাড়ের উপরে এসে নামতে হতো। আর নিচে ছিল এক সুবাসিত পাড়া— নিযুত পুষ্প আনন্দে শরমিন্দায় চিন্ময় ফুটে থাকতো। এখন মুশকিল, নিরাভরণ অবারিত খোলামেলা কোমরদেশ বড় নির্ভার—ঠিক বুঝে ওঠা শক্ত—কী করা যায় কোনো বরফ জমে নেই—ঝকমকে দিন! কেউ কেউ আবার পাহাড়ের ওই মাথার দিকে দ্যাখে— ফুল, নয় ত্রিপিটকের মন্ত্র লেখা চরকা; কী করা যায় এবার তাহলে। বরং ফুল শুকিয়ে যাক প্রসূনের রঙ আবছা মলিন হয়ে উঠুক মন্ত্রলেখা প্রার্থনার চাকতিগুলো আরো নিচে গড়িয়ে পড়ুক যারা উঠে গ্যাছে একবার পাহাড়ের দুর্গমতম চূড়াদেশ বরফের উপর এঁকে দিয়েছে পদচিহ্ন পাহাড়ের পাদদেশ থেকে কী সেই মুদ্রা দেখা যায়নি? পাগলদের টালি এটিকে জ্যাকেটের ভিতর সেঁধিয়ে রাখা হয়েছিল একটিকে পাঠিয়ে দেয়া হলো বাড়িতে আর এ-কে খাবার দেয়া হয়েছিল কিন্তু সে কিছুই মুখে তোলেনি। এটা তারস্বরে বলেছে—না, না, না আর সারা দিনমান ডুকরে কেঁদেছে। ও তাকিয়েছিল জানলার দিকে যেন ওটা জানলা নয়—দেয়াল, আর এই যে এটা গায়েবি কিছু তাকিয়ে দেখছিল যা আসলে ওখানে ছিলই না এই জনা না না বলে চিল্লায় আর রইয়া রইয়া কান্দে সারাদিন। এই যে হেতেনে ভাবে সে একখান পৈখ আর হেইডা ভাবে সে একটি কুকুর তেনায় মনে করেন তিনি একজন মানুষ, এক গৃহস্থ আদম— ভাবে, আর বিলাপ করে না, না, না পুরা বেলা সারাটা দিন।

বদরুজ্জামান আলমগীর: কবি, নাট্যকার, অনুবাদক। জন্মেছেন ভাটি অঞ্চল কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে। পড়াশোনা বাজিতপুরে, পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বহুদিন দেশের বাইরে- যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় থাকেন। বাঙলাদেশে নাটকের দল- গল্প থিয়েটার- এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য; নাট্যপত্রের সম্পাদক। নানা পর্যায়ে আরও সম্পাদনা করেছেন- সমাজ ও রাজনীতি, দ্বিতীয়বার, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, পূর্ণপথিক, মর্মের বাণী শুনি, অখণ্ডিত। প্যানসিলভেনিয়ায় কবিতার আসর- সংবেদের বাগান-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
প্রকাশিত বই::
আখ্যান নাট্য : নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে। আবের পাঙখা লৈয়া।
প্যারাবল : হৃদপেয়ারার সুবাস।
কবিতা : পিছুটানে টলটলায়মান হাওয়াগুলির ভিতর। নদীও পাশ ফেরে যদিবা হংসী বলো। দূরত্বের সুফিয়ানা।
ভাষান্তরিত কবিতা : ঢেউগুলো যমজ বোন।
ছিন্নগদ্য : সঙ্গে প্রাণের খেলা।
প্রকাশিতব্য নিবন্ধ : আশ্চর্য বতুয়া শাক ও কাঁচা দুধের ডিসকোর্স।