থাইল্যান্ডের কবিতা :: ভাষান্তর : মাসুদ খান

Vector illustration of an hand drawing - Two women harvesting rice in asia

অঙ্গকরণ  কল্যাণাপং (১৯২৬-২০১২)। কবি ও চিত্রশিল্পী। তাঁর সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও শিল্পী। জন্ম থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় নাখোন সি তাম্মারাত প্রদেশে। শিল্পকরণ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক– চিত্রকলা, স্থাপত্য ও গ্রাফিক আর্টসে, আধুনিক থাই চিত্রকলার জনক শিল্প বীরশ্রী-র অধীনে। লেখালিখির শুরু গত শতকের ৫০-এর দশকের শেষ দিক থেকে। প্রথম-প্রথম সমালোচিত হন খুব– কবিতার প্রচলিত প্রথা ভাঙার অপবাদে, অপ্রথাগত ভাষা ব্যবহারের অপবাদে। তাঁর বহুল-আলোচিত গ্রন্থ ‘পানিতান কাউয়ি’ (কবির শপথ)-এর জন্য পান সাউথ-ইস্ট এশিয়া রাইট অ্যাওয়ার্ড, ১৯৮৬ তে। বইটিতে কবি ও কবিতা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেন এভাবে: “কবির প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে থাকবে কবিতা। কবিরা হলেন আসমান ও জমিনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। কবিতা হলো কবির শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো”। জাতীয় শিল্পী (সাহিত্য) সম্মানে ভূষিত হন ১৯৮৯ তে। তাঁর শেষদিকের কিছু লেখা ছিল রাজনীতি-প্রাণিত। ভেতরে-ভেতরে ভাগ হয়ে যাওয়া থাইল্যান্ডের গভীর সঙ্কট প্রতিফলিত হয়েছে সেসব লেখায়। চিত্রশিল্পী হিসাবেও বিখ্যাত তিনি। উঁচুমানের বেশ কিছু শিল্পকর্ম রয়েছে তাঁর।]       

হাতা ভরে ভরে সমুদ্র তুলে আনো

হাতা ভরে ভরে, যাও, তুলে আনো গহিন দরিয়া, শাদা-শাদা ভাতের ভোজে আকীর্ণ থালায়
খাবে বলে খামচে তুলে নাও মুঠিভর্তি লবণমেশানো নক্ষত্রকুচি
দ্যাখো নেচে নেচে গীত গেয়ে গোল হয়ে জড়ো হয় কাঁকড়া ও শামুকের দল      
চাঁদ-সূর্য ধরে ধরে খাবে ব’লে ওড়ে গিরগিটি আর কেন্নোর দঙ্গল                         
কুনোব্যাং গিয়ে ওঠে সোনার পালকিতে, স্বর্গের স্রোতের ’পর ভাসমান সফর
তার সাথে সাথে কোলাব্যাং যায়, ফেরেশতা পালায় গিয়ে নারকেল-মালায়  
নিদ্রা যায় যারা নীলাকাশে, সেসব কুমারীদের, তরুণী অপ্সরাদের, কেঁচোরা ফুসলায়                               
প্রত্যেকটি কোষ আর প্রতিটি বীজাণু মুখ তোলে সাফল্যে উজ্জ্বল
বেহেশতি বালাখানায় হাঁপিয়ে-ওঠা ঈশ্বর গু খেতে হামলে পড়ে মর্ত্যের ওপর
অপূর্ব স্বাদের ওই বর্জ্যের তারিফ করে উদ্বৃত্ত কথায়
তরুবীথি, জঙ্গল ও ঝোপঝাড়– পারে তারা ব্যক্ত করতে গভীর দর্শন
কাঠের গুঁড়া বিড়বিড় করে ঘুমের ভেতর হিসাব কষে ছায়াদের কতটা ওজন
ওই গুঁড়া চমৎকার চালাতে পারে আকাশে বাদশাহি, ওই গুঁড়া থেকে যায় মাটি-ঝোঁকা, দুনিয়াবি,
এক ফচকে ফাজিল জগৎ– লালসা আর উন্মত্ত ক্রোধের, রে হাবার দল, চল্, হাতিয়ে নিই বেশি-বেশি ক’রে

কবির অন্তিম ইচ্ছাপত্র

শীত তাড়াবার জন্যে
গায়ে মুড়ি দিই নীলাকাশ
ভাতের বদলে খাই তারার আলোক
রাতের বেলায়।
আকাশের নিচে ঝরে ফোঁটা-ফোঁটা নিশির শিশির
সে-আমারই জন্যে, যাতে আমি খুঁজে পাই আর পিপাসা মেটাই।
ধারা ধরে বের হয়ে আসে সে-শিশির
আমার কবিতা থেকে…
সকালকে সালাম জানাতে, আর টিকে থাকতে যুগ-যুগ।

আমার হৃদয়খানি, যা-কিনা কোরবান তার কবরের নামে,
পেয়ে যায় অলৌকিক এক তেজ;
আত্মা উড়ে স্বপ্নের প্রদেশে যায় আকাশের দূর প্রান্তে।
স্বর্গের নিকট থেকে দিব্যতাকে চেয়ে নিয়ে, ফিরিয়ে আনে তা মর্ত্যে।
সুখ এনে, শান্তি এনে, শান্ত করে ধরিত্রীর বালু আর ঘাস।

এ-আমার যত কবিতা রচনা
একটাই সে-অভিমুখ, উদ্দেশ্য একটাই– আত্মার নাজাত।
যে-আত্মা সওয়ার
এখন, কালের দ্রুত দুর্বিনীত স্রোত আর ঢেউয়ের ওপর।
যদিও জীবন, ঊনদীর্ঘ,
ফুরিয়ে  যাবে যে এত দ্রুত! কিন্তু
হৃদয়ের ফরমান, দিব্য দ্যুতিমান,
টিকে থাকবে চিরকাল।

চিতায় পুড়ুক পোড়া শরীর তোমার–
দেহকে পোড়ানো যায়, কবিতাকে নয়;
তেজ আর মাধুর্য মিশিয়ে গড়া কবিতানিচয়।
যে-লোকেই পুনর্জন্ম হোক-না আত্মার
সেখানেই বয়ে যাবে বন্যা,
রামধনুদের– মহামূল্য, পূতপুণ্যা।
বন্যা বয়ে যাবে
দ্যুতিময় স্ফটিকের, জ্বলজ্বলে রত্নরাজির।

হর্ষে প্রাণিত হয় নিষ্প্রাণতা
লিখিত শব্দের মাজেজায়,
যেইমতো উত্তাপ নেভায়
বেহেশতের মহামূল্য তুমুল বর্ষণ।
হৃদয়কে ক্ষিপ্র উড়িয়ে নিয়ে চলে
স্বপ্ন দেখতে লোকান্তরে, অপর ভূমিতে।
বড়ই মধুর ঘ্রাণ ইহজীবনের।
আর পরজীবনে পড়বে ছায়া সেই মাধুর্যের।

ত্যাজ্য করে দিতে চাই আমার জীবন
চাই সত্যি ছুঁড়ে ফেলে দিতে তাকে।
আমি তো কেবলই চাই মহার্ঘ জিনিশ,
দীপ্তিমান, এবং নতুন।
নিশ্চয়ই সকল শিল্পের মধ্যে
কবিতাই সবথেকে পূত ও পবিত্র,
মায়া ও ম্যাজিক,
যেন-বা ললিত সব কুসুমস্তবক,
বহুমূল্য বন থেকে চয়ন… এবং
ঝরেছে আকাশ থেকে।

[থাই থেকে ইংরেজিঃ সুলাক শিবরক্ষ ও হিরাম উডওয়ার্ড] 

প্রেম ছায়া (১৯১৫ – ১৯৮৩)। বিশিষ্ট কবি, সাংবাদিক ও অনুবাদক। থাইল্যান্ডের সাহিত্য-আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। ছুলালংকর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা বিভাগের ডিন এবং Thailand PEN Centre এর সভাপতি ছিলেন তিনি। প্রিন্স প্রেম পুরাছাত্র নামে সমধিক পরিচিত।]

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রাত

উষ্ণ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রাত নিঃশব্দ হয় না কোনোদিন
বরং মুখর তারা ধ্বনিতে, শব্দরাজিতে, আঁধারে যাদের রেশ থাকে দীর্ঘক্ষণ;
ঘুগরা পোকার ডাক থামে না কখনো
সুরভিত ঘন বায়ুস্তর-কাঁপানো তীক্ষ্ণ চিৎকার মেশানো সেই ডাক;
পদ্মপুকুরের ধারে গলাফোলা কোলাব্যাং তোলে সেরেনাদ, অদ্ভুত, কামদ;
গাছের চূড়ায় নীড়ে বসে, থেকে থেকে,
শাদাডানা কোনো ছোট্ট পাখিনী কলহ করে তার পাখিটার সাথে;
ভোর বলে ভ্রম হয় ক্ষয়ে-আসা চাঁদের মেকি আভায়,
জোরে বাক দিয়ে ওঠে বিনিদ্র মোরগ;
গুল্মের বেড়ার মধ্য দিয়ে চুপিচুপি এগিয়ে গিয়ে
ঘেউ-ঘেউ করতে থাকে কয়েকটি কুকুর, অদৃশ্য কোনো আকৃতিকে লক্ষ ক’রে। 

অসঙ্গতির মাঝে এই যে সঙ্গতি,
অবাক অদ্ভুত, কী সুন্দর শান্ত করে দেয় আমাদের রোদঝলসানো ইন্দ্রিয়নিচয়, 
আমাদের ক্লান্ত আত্মাদের ঘিরে ধরে মধুর নিদ্রায়,
যে-নিদ্রা জড়িয়ে রাখে আমাদের যতক্ষণ-না উঁকি দেয় ভোর।

লাখ-লাখ জখমের দাগে ভরা খাল

লম্বা-লম্বা ক্যাজুয়ারিনার বনে বয়ে যায় বাতাসের দীর্ঘশ্বাস
হাওয়া গুমরে মরে বাঁশঝাড়ে, পানির কিনারে,
দমকা হাওয়া ছোটে তারপর রোদে-সেঁকা পোড়া মাঠে,
পেছনে ফেলে আসে ছোট-ছোট কিছু নাচুনে ঢেউ–
ধানবোঝাই নৌকার বহর টানতে টানতে
ভাটির পানে ভটভট বয়ে চলে বাষ্পচালিত টাগবোট, ধানকলের দিকে–
আর সেই ভটভটি ছোট-ছোট হিল্লোলকে চ্ছলচ্ছল বদলে দেয় বড়-বড় কল্লোলে।
সওদাভরা সব হালকা-পলকা ডিঙিনৌকা,
প্রতিটি ঢেউ এসে আলতো দোলাতে থাকে তাদের,
নাচুনে ঢেউ তাদেরও নাচায়,
শেষে গিয়ে ঝাঁকিয়ে দেয় খালপাড়ের সবুজ নলখাগড়াদের,
যেখান থেকে উড়ে উঠবে লাখ-লাখ মশা, লাখ-লাখ জখমচিহ্নের মতো,
ডুবে যাবে ক্লান্ত সূর্য পশ্চিমে যখন।
এজন্যেই আমাদের বাপদাদারা খালটিকে বলতেন ‘লাখো জখমদাগি খাল’,
ঠিকই বলতেন।

একটি প্রভাতী ভাবনা

অনন্তের কাননে একটি শিশিরফোঁটা–  এ হচ্ছে তা-ই
যা আমরা, ভূলোকবাসীরা, নিরন্তর হয়ে উঠতে চাই।  
স্বর্গ-হতে-ঝরে-পড়া সেই বিন্দুশিশির ঝরায় মর্ত্যে তার দ্যুতিভার
অথচ যখন সূর্য ওঠে কুসুম-কুসুম, খুঁজে পাওয়া ভার চিহ্নটুকু তার;
দৈবাৎ একটি কুসুমের ’পর ঝরতে পারে একটি শিশিরফোঁটা, হেথা কিংবা অন্য কোথা, অন্য…
ফুল ঝরে পড়া অব্দি সেই ফোঁটা ফুটিয়েই যাবে ওই ফুলের লাবণ্য। 

বাঁশি

বহুবার, বহুবারই, এক পিচকালো ঝিরঝির বৃষ্টিঝরা রাতে
শুনেছি বাঁশির ডাক, যার সবিলাপ সুর
উঠে যেত বৃষ্টির অনড় অবিচল টাপুরটুপুরের অনেক ওপরে
এবং মিলিয়ে যেত, আমার হৃদয়ে ফেলে রেখে যেত এক প্রতিধ্বনি;
যুদ্ধের চাকার অবিশ্রান্ত ঘর্ঘরের মধ্যে এক
দীর্ঘরেশ কান্নার আওয়াজ নিয়ত দোলাতে থাকে আমার হৃদয়।

[থাই থেকে ইংরেজিঃ রিয়েম ইং]

লেখক-পরিচিতি:

10665940_10152415927716378_8839597581322075827_n

মাসুদ খান। কবি, লেখক, অনুবাদক। জন্ম ২৯ মে ১৯৫৯, জয়পুরহাট। পৈতৃক নিবাস সিরাজগঞ্জ। প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক, ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর। তড়িৎ ও ইলেকট্রন প্রকৌশলী। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : পাখিতীর্থদিনে (১৯৯৩) নদীকূলে করি বাস (২০০১) সরাইখানা ও হারানো মানুষ (২০০৬) আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি (২০১১) এই ধীর কমলাপ্রবণ সন্ধ্যায় (২০১৪) দেহ-অতিরিক্ত জ্বর (২০১৫)।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s